বিকল্প থাকা সত্ত্বেও ৩ গুন দামে কেনা হয় আদানির বিদ্যুৎ
বাংলাদেশের বিভিন্ন বিদ্যুৎ কোম্পানি ক্যাপাসিটি চার্জের নামে বছরে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। এতে যোগ হয়েছে ভারতের আদানি গ্রুপ। তারা ক্যাপাসিটি চার্জের নামে বাংলাদেশ থেকে এক লাখ ২৬ হাজার ৫৮১ কোটি টাকা নেবে। এছাড়া অস্ট্রেলিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে তাদের কয়লা আনতে বাংলাদেশকে গুনতে হচ্ছে বিপুল পরিমাণ খরচ।
শুধু কয়লার জন্য ৪৫ শতাংশ বেশি মূল্য দিতে হবে। সমস্ত অর্থপ্রদান অবশ্যই মার্কিন ডলারে করতে হবে। তথ্য গোপন করে ভারতের আদানি পাওয়ার লিমিটেড বাংলাদেশের সঙ্গে এই ভয়াবহ বৈষম্যমূলক চুক্তি করে রেখেছে পতিত আওয়ামীলীগ সরকার । এ প্রকল্পে বাংলাদেশের ক্যাপাসিটি চার্জ ও কয়লা আমদানি ব্যয় কমানোর কথা থাকলেও বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। সব মিলিয়ে বাংলাদেশকে আদানি থেকে প্রায় তিনগুণ বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনতে হবে।
আদানি গ্রুপ বাংলাদেশ থেকে বিদ্যুতের রপ্তানি মূল্য মার্কিন ডলারে নিচ্ছে, যা মূল খরচের চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি। দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ অস্বাভাবিক বৃদ্ধির প্রায় ৮ শতাংশের জন্য এই ভারতীয় কোম্পানি একাই দায়ী। যদিও দেশে উৎপাদন সক্ষমতা ও চাহিদার বিবেচনায় যা দরকার ছিল না বলে মত বিশেষজ্ঞদের।
বিশেষজ্ঞদের মতে, তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার বিদ্যুৎ খাতে ক্রয় ও চুক্তিতে ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থকে গুরুত্ব দিয়েছিল। পুনর্মূল্যায়ন করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা।
২০২৩ সালের মার্চ মাসে, ভারতের ঝাড়খণ্ডের গোড্ডায় আদানির কয়লা-চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে আমদানি শুরু হয়। সেখান থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৬০০ মেগাওয়াট কেন্দ্র থেকে গড়ে ১৪ টাকার বেশি দামে বিদ্যুৎ কেনা হয়।
অন্যদিকে, ভারতে অন্যান্য ৪টি উৎস থেকে আমদানি করা ১০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের গড় দাম ছিল 8 টাকার নিচে। ভারতে নিজের ১০,০০০ মেগাওয়াট অতিরিক্ত উৎপাদন ক্ষমতা রেখে সেই কোম্পানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনার যৌক্তিকতা নিয়ে সবসময়ই প্রশ্ন উঠেছে। বিশ্লেষকদের মতে, বিদায়ী সরকারের পদক্ষেপের কারণে সক্ষমতা চার্জ ও বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ের চাপ বেড়েছে।
এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ার সম্পাদক মোল্লা আমজাদ গণমাধ্যমকে বলেন, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি এভাবে বন্ধ না করলেও চলতো। নিজস্ব সম্পদ ব্যবহার না করে রাজনৈতিক ও গোষ্ঠী স্বার্থে প্রকল্প গ্রহণের কারণে এ খাত আজ নাজুক অবস্থায় রয়েছে।
গত অর্থবছরে পিডিবি দেশের কয়লাভিত্তিক প্ল্যান্ট থেকে প্রতি ইউনিট ১৩ টাকা থেকে ১৬ টাকায় বিদ্যুৎ কিনেছিল। বর্তমানে প্রতি টন কয়লার দাম ১০০ ডলারে নেমে এসেছে।
বর্তমানে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে মোট বকেয়া ২২০ মিলিয়ন ডলার। ভারতের রাজস্ব পাবে ৮০ কোটি ডলার। এদিকে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর মোদি সরকার আদানিকে ভারতেও বিদ্যুৎ বিক্রির অনুমতি দিয়ে নিয়ম সংশোধন করেছে।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। ভারতের বিভিন্ন কোম্পানি তাদের পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশে ব্যবসা করছে। এর মধ্যে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আদানি গ্রুপ সবচেয়ে বেশি আলোচিত। এই কোম্পানি বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রপ্তানি করছে। যে সময়ে বাংলাদেশ সরকার বিদ্যুৎ আমদানির জন্য আদানি গ্রুপের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল, তখন বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ১২,০০০ মেগাওয়াট এবং বাংলাদেশী গ্রাহকদের দ্বারা বিদ্যুতের ব্যবহার ছিল ৮,২০০ মেগাওয়াট। পরবর্তী বছরগুলোতে বাংলাদেশে তিনটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। তাই এই সময়ে বাংলাদেশে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়লেও আদানির কোনো বিদ্যুতের প্রয়োজন নেই।
আদানি গ্রুপের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের বিদ্যুৎ আমদানি চুক্তি বহু বছর গোপন রাখা হয়েছিল। চুক্তিটি প্রকাশ্যে আসার পর বাংলাদেশ-ভারতসহ বিশ্বের গণমাধ্যম ও কূটনৈতিক মহল চুক্তির শর্ত দেখে বিস্মিত। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ আমদানি না করলেও আদানিকে প্রতি কিলোওয়াটের দামের ৩৪ শতাংশ দিতে হবে।
৬ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের ইনস্টিটিউট অব এনার্জি ইকোনমিক অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিস নামের একটি সংস্থা চুক্তিগুলো বিশ্লেষণ করে এ তথ্য জানতে পারে। চুক্তির বিষয়ে তাদের মন্তব্য ছিল যে, প্রকল্পটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল, সময়ের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ এবং বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে নতুন সরকার গঠিত হয়েছে, অর্থনৈতিক অবস্থা কিছুটা দুর্বল হয়েছে, মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। এ অবস্থায় আদানির সঙ্গে বিদ্যুতের চুক্তি কার্যকর হবে কি না, বাতিল হবে কি না, নবায়ন হবে কি না- এসব বিষয়ে কিছুই জানা যায়নি।
অন্যদিকে, আদানি গ্রুপ ভারতের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পাওয়ার ফাইন্যান্স কর্পোরেশন এবং গ্রামীণ বিদ্যুতায়ন কর্পোরেশন থেকে ঋণ নিয়ে ঝাড়খণ্ড, ওড়িশায় বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করেছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য অস্ট্রেলিয়া থেকে কয়লা আমদানি করছে। ভারত সরকার এই পরিষেবাগুলির জন্য আদানি থেকে কোনও শুল্ক বা কর নেয়নি।
ঝাড়খণ্ডে, যেখানে আদানির পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়েছে, সেখানে একটি টাকাও খরচ করা হয়নি। এছাড়া আদানি গ্রুপ বাংলাদেশ থেকে বিদ্যুতের রপ্তানি মূল্য মার্কিন ডলারে নিচ্ছে, যা মূল খরচের চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি।
অর্থাৎ বাংলাদেশ সরকার ও আদানি গ্রুপের মধ্যে এই বিদ্যুৎ রপ্তানি চুক্তির মাধ্যমে ভারত সরকার কোনো সুবিধা পাচ্ছে না। ভারতের মানুষ কোনো সুফল পাচ্ছে না। বাংলাদেশেরও কোনো লাভ নেই। একমাত্র সুবিধাভোগী হলেন আদানি গ্রুপের প্রধান গৌতম আদানি।