গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করল বাংলাদেশ
রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গুমের অভিযোগে দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে রয়েছে বাংলাদেশ। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ‘আয়না ঘর’ নামে পরিচিত গোপন আটক কেন্দ্র থেকে দীর্ঘদিন পর বেশ কয়েকজনকে ছাড়ার পর গুমের বিষয়টি সামনে আসে।
নিখোঁজদের স্বজনরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়েও এই মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার পাননি। এ অবস্থায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আন্তর্জাতিক গুমবিরোধী কনভেনশনে যোগ দিয়েছে।
গেলো, ২৯/০৮/’২৪ বৃহস্পতিবার গুম বিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস স্বাক্ষর করেন।
বৃহস্পতিবার ২৯ আগস্ট উপদেষ্টা পরিষদের সাপ্তাহিক বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এই সনদে স্বাক্ষর করেন। এ সময় প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এটি আমাদের জন্য একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত।
৩০ আগস্ট আন্তর্জাতিক গুম বিরোধী দিবসের আগে বাংলাদেশ এই সনদে যোগ দিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা প্রেস ইউং গুম বিরোধী সনদে স্বাক্ষরের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গুমের ঘটনা তদন্তে হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করেছে সরকার। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করে গত ২৭ আগস্ট প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
কমিশন অফ ইনকোয়ারি অ্যাক্ট, ১৯৫৬-এর ক্ষমতাবলে এই কমিটি গঠনের কথা উল্লেখ করে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ‘আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলি যথা- বাংলাদেশ পুলিশ, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), বিশেষ বাহিনী। শাখা, গোয়েন্দা শাখা, আনসার ব্যাটালিয়ন, জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই), প্রতিরক্ষা বাহিনী, ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স (ডিজিএফআই), কোস্ট গার্ডসহ দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও এনফোর্সমেন্ট এজেন্সিগুলোর যে কোনো সদস্য, কমিশনসহ ‘বলপ্রয়োগকৃত নিখোঁজ ব্যক্তিদের সন্ধানে’ ‘
রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গুমের অভিযোগে দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে রয়েছে বাংলাদেশ। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ‘আয়না’ নামে পরিচিত গোপন আটক কেন্দ্র থেকে দীর্ঘদিন পর বেশ কয়েকজনকে ছাড়ার পর গুমের বিষয়টি সামনে আসে।
বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে ৭০০ জনের বেশি মানুষ গুম হয়েছে। এদের মধ্যে দেড় শতাধিক জনের খোঁজ এখনো পাওয়া যায়নি।
জাতিসংঘের দীর্ঘদিনের অনুরোধ সত্ত্বেও বিগত সরকার গুম বিরোধী কনভেনশনে স্বাক্ষর করেনি। অন্তর্বর্তী সরকার মানবাধিকার সমুন্নত রেখে গুমের সংস্কৃতির অবসান চায়। এ লক্ষ্যে গুমবিরোধী সনদে যুক্ত হয়েছে সরকার।
ছাত্র বিপ্লবের মাধ্যমে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ক্ষমতায় আসার পর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দেশবাসীকে প্রতিটি গুমের তদন্ত ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. গত সোমবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, র্যাবসহ সরকারি বাহিনীর সদস্যরা গুমের মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। খুন, নির্যাতন’ চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়া হবে। তিনি বলেন, ‘ফ্যাসিবাদী সরকারের বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, খুন, অপহরণ, আয়না ঘরের মতো জঘন্য অপরাধের বিচার নিশ্চিত করা হবে। এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। তালিকা তৈরি করে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করা হবে। দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের বিচার হবে।
প্রধান উপদেষ্টার বক্তৃতার একদিন পরে গঠিত কমিশনের শর্তাবলীতে বলা হয়েছে যে ১জানুয়ারী, ২০১০থেকে 5 আগস্ট, ২০২৪ পর্যন্ত ব্যক্তিরা কোন পরিস্থিতিতে নিখোঁজ হয়েছে তা সনাক্ত, সনাক্ত এবং নির্ধারণ করার ক্ষমতা দেওয়া হবে।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘জোরপূর্বক গুম হওয়ার ঘটনাসমূহের বিবরণ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট দাখিল করা এবং এতদ্বিষয়ে সুপারিশ প্রদান করা; জোরপূর্বক গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান পাওয়া গেলে তাহাদের আত্মীয়-স্বজনকে অবহিত করা এবং জোরপূর্বক গুম হওয়ার ঘটনা সম্পর্কে অন্য কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পরিচালিত তদন্তের তথ্য সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে এই কমিশন।’
গুমবিরোধী সনদটি ডিসেম্বর ২০০৬ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গৃহীত হয়েছিল। ৩২টি দেশ এতে স্বাক্ষর করার পর ২০১০ সালে এর বাস্তবায়ন শুরু হয়। সামগ্রিকভাবে এই সনদের লক্ষ্য গুম বন্ধের পাশাপাশি এই অপরাধের জন্য দায়মুক্তি বন্ধ করা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সহায়তা দেওয়া।
গুমবিরোধী সনদে গুম বা অন্তর্ধানকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। জাতিসংঘের ১০-সদস্যের একটি কমিটি এই সনদটি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা নিশ্চিত করতে কাজ করে। কমিটি রাষ্ট্রপক্ষের বিভিন্ন প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই করে। সনদের ৩৩ অনুচ্ছেদ অনুসারে, সনদের পক্ষভুক্ত কোনো দেশে নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা ঘটলে, কমিটির সদস্যরা পরিস্থিতি দেখতে ওই দেশে যেতে পারেন। তবে এখনো অনেক দেশই এই অনুচ্ছেদের বিধান মেনে নেয়নি।
সনদে মোট ৪৫টি প্রবন্ধ রয়েছে। যদি জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র এটির পক্ষ হয়, তবে এটি সনদের “এক বা একাধিক নিবন্ধ মেনে না চলার” সিদ্ধান্ত জাতিসংঘকে জানাতে পারে।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ এই সনদে স্বাক্ষর করেছে; অর্থাৎ এটাকে তাদের অভ্যন্তরীণ আইনের অংশ হিসেবে গ্রহণ করেছে। এছাড়াও ভারত শুধুমাত্র এতে স্বাক্ষর করেছে কিন্তু অনুমোদন করেনি। অন্যদিকে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্যের মধ্যে শুধুমাত্র ফ্রান্সই এতে স্বাক্ষর করেছে।
নিখোঁজ বিরোধী সনদে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে জানতে চাইলে জেনেভায় জাতিসংঘ মিশনে বাংলাদেশের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি মোহাম্মদ সুফিউর রহমান বলেন, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক গুম-বিরোধী সনদে একটি দেশ হয়েছে, যা শুধু মানবাধিকার রক্ষার জন্য নয়। মানবাধিকারের পাশাপাশি এতে আইনের শাসন, গণতান্ত্রিক অনুশীলন, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মতো বিষয় জড়িত।
আরো পড়ুন
1 Comment