বন্যার্তদের সাহায্যে টিএসসিতে এক মানবিক স্বস্তির উৎসব!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি, গেট দিয়ে একের পর এক গাড়ি ঢুকছে। কারও গাড়িতে কাপড়, শুকনো খাবার নিয়ে আসছেন। কেউ আবার এনেছে মেয়েদের জন্য স্যানিটারি ন্যাপকিন নিয়ে । এমনকি কম্বল, লুঙ্গি, বিছানার চাদর, বালিশ, তোষক এবং আরও অনেক কিছু নিয়ে। একের পর এক গাড়ি ঢুকছে আর গাড়ি থেকে ত্রাণ ব্যাগ বের হচ্ছে। এ যেন এক মানবিক স্বস্তির উৎসব!
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত দেশের কয়েকটি জেলা। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন দুস্থ এলাকার বাসিন্দাদের জন্য জনসাধারণের ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে এ কার্যক্রম চলছে। জনগণ সহযোগিতা করছে। সাত দিন পার হলেও জনগণের সহযোগিতার মনোভাব কমেনি। মানুষ সাধ্যমতো দান করছে। এখন নগদ আসছে। সাত দিনে জনস্বার্থে যোগ হয়েছে প্রায় আট কোটি টাকা। এ যেন অন্য বাংলাদেশ। দেশের জন্য বিপদে পড়া মানুষের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে একদল শিক্ষার্থী।
গতকাল দুপুরে টিএসসি এলাকায় দেখা যায়, সাধ্যমতো ত্রাণ দিচ্ছেন মানুষ। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাত-আটজন শিক্ষার্থী টাকার বাক্স নিয়ে আসেন। তাদের বাক্সে ছিল ২৭ হাজার ৮৩২ টাকা। এ টাকা নিয়ে আসা সোনালী দাস বলেন, আমরা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার রামপুরা ও আশপাশের সড়কে টাকা সংগ্রহ করেছি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে ত্রাণ নেওয়া হয়েছে। তাই আমরা জনস্বার্থে এই টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। তিনি বলেন, অনেক এলাকা নতুন করে বন্যার কবলে পড়েছে। ফেনীতে বন্যার পর একটি হাইপ ছিল। আমরা প্রচার চালিয়ে যেতে চাই. নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ায়, পানি কমার পর বাসিন্দাদের নগদ অর্থের প্রয়োজন। তাই আমরা টাকা সংগ্রহ করতে থাকি।
এক বয়স্ক দম্পতি ৫০ হাজার টাকা অনুদান দিয়েছেন। তারা অনুদান দেওয়ার পর প্রচারণা চালাতে চান না। তারা বলেন, আমরা দুজনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম । দেশের দুর্যোগে আমরাও ঝাঁপিয়ে পড়লাম। তরুণ-তরুণীরা এখনো সেভাবে এগুচ্ছে। এটাই বাংলাদেশ। আমরা নিঃসন্তান। এই সাহসী শিক্ষার্থীরা আমার সন্তান। তাই আমি আমার সন্তানদের যতটা সম্ভব সাহায্য করেছি। প্রায় ১০ বছর পর বিশ্ববিদ্যালয়ে এলাম। দেশের বাইরে থাকায় ক্যাম্পাসে আসা হয়না। আমি এসে অভিভূত হয়ে গেলাম। বাংলাদেশ এটাই চায়।
এক মানবিক রিকশাচালক বলেন, আমি গরিবদের ১০০ টাকা দিয়েছি। আমার এই টাকা দিয়ে যদি কেউ একবেলা খাবার পায়, সেটাই আমার জন্য অনেক কিছু।
নারায়ণগঞ্জের এক ভদ্র মানুষ বলেন, যতদিন প্রয়োজন ততদিন আমরা এই অর্থ সংগ্রহ চালিয়ে যাব। মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে টাকা দেয়। জনগণ সহযোগিতা করতে চায়। তাদের একটি সঠিক চ্যানেল দরকার। আমরা এই দায়িত্ব নিয়েছি। এমনকি একজন অন্ধ ভিক্ষুকও আমাদের ১০ টাকা দিয়েছে। এই দৃশ্য দেখে আমরা চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি।
এদিনে ব্যক্তি উদ্যোগের পাশাপাশি সংগঠনের লোকজনও বেশি দেখা যায়। একজন লোক তার পোশাক থেকে২৪ টি কার্টুন জামা নিয়ে এসেছে। তিনি বলেন, এগুলো পরতে পারবেন ১৫০০ জন। একটি চীনা কোম্পানিও দেখা যাচ্ছে। জনস্বার্থে দশটি সোলার প্যানেল নিয়ে এসেছে সংগঠনের কেউ কেউ। এ সময় তারা বলেন, আমরা এগুলো বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন এলাকায় ব্যবহারের জন্য নিয়ে এসেছি।একজন একটি মিনি পিকআপে কিছু বস্তা খালাস করছেন। তিনি বলেন, খিচুড়ি রান্নার জন্য যা যা লাগবে সব নিয়ে এসেছি। আশা করি, এটি ঠিকমতো রান্না করা হলে এক বেলায় পাঁচ থেকে ছয় হাজার মানুষ খেতে পারবে।
শিশু থেকে বৃদ্ধ নারী-পুরুষ একের পর এক টাকা নিয়ে হাজির। অনেক শিশু তাদের সঞ্চয় ত্রাণ তহবিলে নিয়ে এসেছে। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ুয়া মুসকান বলেন, ঈদের সালামি নিয়ে গত দুই বছর ধরে এই টাকা জমিয়ে রেখেছি। আজ সবাইকে নিয়ে ত্রাণ বাক্সে দিতে এসেছি।
আরেকটা ছোট বাচ্চা তার ব্যাংকে জ্বর নিয়ে এসেছে। খুশি নিঃস্বার্থ ছয় বছরের শিশু তার নিজের হাতে তার অর্থ দান করে। তার মাও তার উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলেছেন, ‘এ ধরনের একটি অনুষ্ঠানের অংশ হতে পেরে সত্যিই আনন্দের। এই বাংলাদেশ দেখে স্বস্তি লাগে।
অনেক মহিলাও নিজেদের সঞ্চয় নিয়ে হাজির হন। একজন ডাক্তার৭৫,০০০ টাকার বান্ডিল দিয়ে বললেন, ‘এই ছাত্রদের কাজ দেখে আয়ু বেড়েছে। মনে হয় তাদের থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত। তারা আমাদের সুন্দর বাংলাদেশ উপহার দেবে। সবাই মিলে এভাবে কাজ করলে কোনো বিপদ আমাদের ক্ষতি করতে পারবে না।
এই ডাক্তারের কথাগুলো হয়তো হাজারো মানুষের হৃদয়ের কথা। শিক্ষার্থীদের পরিশ্রমে আবারও আশার আলো দেখবে বন্যা দুর্গতরা। সেই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের প্রয়াস আগামীতে উপহার দেবে একটি নতুন বাংলাদেশ!
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে সমন্বয়কারী লুৎফর রহমান বলেন, এখন আমরা জনসাধারণের রান্নার কর্মসূচি হাতে নিয়েছি। কুমিল্লার কয়েকটি স্পটে এরই মধ্যে শুরু হয়েছে গণ রান্না। এ সময় তিনি যতদিন প্রয়োজন ততদিন এ কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।