জনতা ব্যাংকের এক শাখা থেকেই ২৭ হাজার কোটি টাকা লুট করেছে সালমান
দমন-পীড়ন আর অবৈধভাবে একনাগাড়ে ১৬ বছর ক্ষমতায় থাকার কারণে বাংলাদেশে অনেক রাঘব বোয়ালের সৃষ্টি হয়েছে। যারা নামে বেনামে অবৈধভাবে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছে। এবার গণঅভ্যুত্থানে, ছাত্র আন্দোলনে, বিপ্লবে তাদের চেহারা ফুটে উঠেছে।এবং আল্লাহও তাদের পাকড়াও করে জনগণের সামনে তুলে ধরবেন। আমরা চেষ্টা করব একে একে এই সকল খাদকদের লেখার মাধ্যমে চিত্রায়ন করার।
সম্প্রতি পলাতক হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা বিকৃত আবরণে পালিয়ে যেতে গিয়ে ধরা পড়া সালমান এফ রহমান রিমান্ডে নিয়ে গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিতে শুরু করেছেন। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি তার অর্থ লোপাটের বিভিন্ন গল্প গোয়েন্দাদের বলেন। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন ও বিভিন্ন ব্যাংকের নথিতে অর্থ লোপাটের চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যায়।
জনতা ব্যাংকের একটি শাখা থেকে ঋণের নামে প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকা নিয়েছিল সালমান এফ রহমান। যা ওই শাখার মোট ঋণের ৬৫ শতাংশ। এসব ঋণের বেশির ভাগই ছিল বেনামে। পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে তার নামে বেনামি ঋণ সংযুক্ত করা হয়। জনতা ব্যাংকের নথি খতিয়ে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যাংকার বলেন, সালমান এফ রহমান বেনামি ঋণের জনক। যা ধীরে ধীরে পুরো ব্যাংকিং খাতে ছড়িয়ে পড়ে। এখন প্রায় সব অসাধু ব্যবসায়ীরই বেনামি ঋণ রয়েছে। বেনামী ঋণকে পিতৃহীন শিশুদের সাথে তুলনা করা হয়। অবৈধ সন্তানের পিতাকে যেমন খুঁজে পাওয়া যায় না, তেমনি বেনামি ঋণের সুবিধাভোগীকেও খালি চোখে দেখা যায় না।
তিনি আরও বলেন, ব্যাংক খাতে সবচেয়ে বেশি ডাকাতি হচ্ছে বেনামি ঋণ। অর্থাৎ একজন ঋণ নেয়, অন্যজন তা ভোগ করে। প্রকৃত সুবিধাভোগীরা সর্বদা অধরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত সব ধরনের বেনামি ঋণ খুঁজে বের করা। তা না হলে ব্যাংকিং খাত টিকবে না। বাংলাদেশ ব্যাংক ও জনতা ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, বেক্সিমকো গ্রুপের নামে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয় এবং গ্রুপ সংশ্লিষ্ট ৩২টি প্রতিষ্ঠান থেকে মোট ২৬ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঋণ নেওয়া হয়েছিল ২০২১, ২২ এবং ২৩ সালে। এর মধ্যে অ্যাডভেঞ্চার গার্মেন্টস ৬০৯ কোটি, অ্যাপোলো অ্যাপারেলস ৭৯৮ কোটি, অটামলুপ অ্যাপারেলস ৮২২ কোটি, বে সিটি অ্যাপারেলস ৮৯২ কোটি, বেক্সিমকো লিমিটেড ২ হাজার ২১৬ কোটি, বেক্সিমকো পিপিই ২৬ কোটি, বেক্সিমকো ফ্যাশনস ৯৩৬ কোটি, বেক্সটেক্স গার্মেন্টস ৮৮৫ কোটি, কসমোপলিটান অ্যাপারেলস ৯৬১ কোটি, কজি অ্যাপারেলস ৯০৬ কোটি, ক্রিসেন্ট ফ্যাশন অ্যান্ড ডিজাইন ১ হাজার ৬৯০ কোটি, এসকর্প অ্যাপারেলস ৮১৯ কোটি, অ্যাসেস ফ্যাশনস ১ হাজার ৭৫৮ কোটি, ইন্টারন্যাশনাল নিটওয়্যার অ্যান্ড অ্যাপারেলস ১ হাজার ২৫০ কোটি, ইন্টারন্যাশনাল নিটওয়্যার অ্যান্ড অ্যাপারেলস ইউনিট-টু ৬৪৯ কোটি, কাঁচপুর অ্যাপারেলস ৭৫৯ কোটি, মিডওয়েস্ট গার্মেন্টস ৭৩২ কোটি, নিউ ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজ ১ হাজার ৬৮৬ কোটি, পিয়ারলেস গার্মেন্টস ৯৬০ কোটি, পিংক মেকার অ্যাপারেলস ৯০২ কোটি, প্লাটিনাম গার্মেন্টস ৮৩৭ কোটি, শাইনপুকুর গার্মেন্টস ৩৩৩ কোটি, স্কাই নেট অ্যাপারেলস ৭৩৮ কোটি, প্রিংফুল অ্যাপারেলস ৭৬০ কোটি, আরবান ফ্যাশনস ৭০৪ কোটি, হোয়াইট বে অ্যাপারেলস ৮৮৫ কোটি, ইউন্টার স্প্রিন্ট গার্মেন্টস ৭৭২ কোটি, ইয়োলো অ্যাপারেলস ১ হাজার ৫০ কোটি, ক্রিসেন্ট অ্যাকসেসরিজ ৯৬ কোটি, আর আর ওয়াশিং ৯৭ কোটি, এসকর্প এলপিজি ১১ কোটি ও বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস ৩৬০ কোটি টাকা। এসব ঋণের বেশির ভাগই ছিল বেনামি প্রতিষ্ঠানের নামে। পরে বাংলাদেশ ব্যাংক বেক্সিমকো গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানির নামে সেগুলো দেখায়।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, মানুষ হত্যার অভিযোগে তিনি এখন কারাগারে। তার বিরুদ্ধে আর্থিক অপরাধের মামলাও হতে পারে। আবার ব্যাংকের এমডি, বোর্ড ও বাংলাদেশ ব্যাংকও এ প্রক্রিয়ায় জড়িত। কারণ তিনি কারো খেয়াল না করে এক শাখা থেকে এত টাকা উত্তোলন করেননি। সবাই জানে। তাই নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে সবার শাস্তি হওয়া উচিত। জামানত থেকে থাকলে সেটা বাজেয়াপ্ত করতে হবে। আর শুধু এক শাখা নয়, আরও কোথা থেকে কত টাকা নিয়েছেন, সেসব বের করতে হবে।
আরো পড়ুন