শহীদ আবু সাঈদ নিহত:পুলিশের গুলির উল্লেখ নেই এফআইআরেঃ গুলিতে ঝাঁঝরা সাঈদের বুক, পুলিশ বলছে উল্টো কথা
রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদেরবুক ও পেট পুলিশের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল। তাঁর গলা থেকে ঊরু পর্যন্ত ছিল ছররা গুলির আঘাত। তবে পুলিশের মামলার প্রাথমিক তথ্য প্রতিবেদনে (এফআইআর) বলা হয়েছে উল্টো কথা, পুলিশ বলছে আন্দোলনকারীদের গুলি ও ইটপাটকেলের একপর্যায়ে আবু সাইদের মৃত্যু হয়।
কোটা আন্দোলনের সময় রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদের মৃত্যুর বিষয়ে এফআইআরে পুলিশের গুলিতে কোনো উল্লেখ নেই। শিক্ষার্থীরা জানায়, সাঈদকে সামনে থেকে পুলিশ গুলি করে। এ দৃশ্য সব গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু এফআইআর-এ তার উল্লেখ না করে পুলিশ নিজেদের কলঙ্কিত করে চলেছে। ভিডিওটিতে পুলিশকে গুলি চালাতে যা তামাম দুনিয়া দেখা যাচ্ছে, আবু সাঈদের মৃত্যুর ঘটনায় অন্যদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা বলছেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় আবু সাইদ পুলিশের গুলিতে নিহত হলেও এ হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট মামলা হয়নি। উল্টো নিজেদের দোষ ঢেকে বিক্ষোভকারীদের দোষারোপ করেছে পুলিশ।
শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন প্রকাশ্যে বুকে গুলি করে মারার ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে দেখা গেছে। তাছাড়া আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল না, ভিডিও দেখলেই প্রমাণ হবে। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গত ১৬ জুলাই দুপুরে আবু সাইদ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিছিলে অংশ নেন।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন তিনি। সামনে থেকে মিছিলের নেতৃত্ব দেন তিনি। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ মিছিল বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রবেশের চেষ্টা করলে পুলিশ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা তাদের বাধা দেয়। একপর্যায়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। রণক্ষেত্রে পরিণত হয় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। এ সময় পুলিশ শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাস, রাবার বুলেট ও কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়ে। আবু সাঈদ একা দাঁড়িয়ে মুখোমুখি হওয়ার চেষ্টা করলেন। আবু সাঈদকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে পুলিশ। এতে তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তাকে রংপুর মেডিকেলে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। পরে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা মিছিলে আবু সাঈদের লাশ নিয়ে বেরোবি আসা-যাওয়ার পথে কাচারিবাজার এলাকায় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে লাশ নিয়ে যায় পুলিশ।
এদিকে কোটা পদ্ধতি সংস্কার আন্দোলনে নিহত আবু সাঈদের মৃত্যুর ১১ দিন পেরিয়ে গেলেও তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও পুলিশের গঠিত তদন্ত কমিটি। আন্দোলনকারীদের গুলিতে আবু সাঈদের মৃত্যুর বিষয়টি পুলিশি মামলায় উল্লেখ করায় বিভিন্ন মহল ক্ষোভ প্রকাশ করেছে।
ইতিহাস তাই বলে যে, দাম্ভিক এবং অত্যাচারী স্বৈরাচারী শাসকেরা মানুষের উপরে এবং মানবতার উপর জুলুম করার পর উল্টা তাদের উপরই দোষ চাপিয়ে দেয়। এবং সেখানে উল্টো আরো চরম অত্যাচার করে বসে। আর সেই ক্ষেত্রে সহযোগিতা করে সেই অত্যাচারীদের নিয়োগ প্রাপ্ত একদল অত্যাচারী প্রোটেকশন বাহিনী। যেটা শহীদ আবু সাঈদ এর ক্ষেত্রেও ঘটতে চলছে। তবে সত্যি প্রকাশিত হবেই, জালিমরা ছাড় পাবেনা, অত্যাচারেরা রক্ষা পাবেনা। সৃষ্টিকর্তার বিধান এবং ইতিহাস সেটাই সাক্ষ্য দেয়।
গত ১৬ জুলাই কোটা পদ্ধতি সংস্কার আন্দোলনে নিহত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় ফাঁড়ির ইনচার্জ বিভূতি ভূষণ রায় বাদী হয়ে মামলা করেছেন। গত ১৭ জুলাই তাজহাট থানায় এ মামলা হয়। মামলার বিবরণে বানিয়ে সাজিয়ে উল্লেখ করা হয়, ‘বিভিন্ন দিক থেকে আন্দোলনকারীদের গুলি ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের সময় এক ছাত্রকে রাস্তায় পড়ে যেতে দেখা যায়। পরে সহপাঠীরা তাকে ধরে জরুরী চিকিৎসার জন্য বিকেল ৩টা ৫ মিনিটে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। নিহত ছাত্রের নাম আবু সাইদ (২৩)। পিতা-মকবুল হোসেন, সাং-জাফরপাড়া বাবনপুর, থানা-পীরগঞ্জ, জেলা রংপুর মেডিকেল সূত্রে জানা গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে সংঘর্ষ ও আবু সাঈদের মৃত্যুর ঘটনায় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও মেট্রোপলিটন পুলিশ পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
এর মধ্যে গত ১৮ জুলাই ভাইস চ্যান্সেলরের নির্দেশে ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. আহ্বায়ক মতিউর রহমান, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. শফিকুর রহমান, সদস্য সচিব ও রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. বিজয় মোহনকে সদস্য করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দ্রুত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত ওই কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি। এ প্রসঙ্গে তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব মো. শফিকুর রহমান বলেন, তদন্ত প্রক্রিয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে। শিগগিরই প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে। অন্যদিকে, একই ঘটনায় গত ১৭ জুলাই অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার সাইফুজ্জামান ফারুকীকে তলব করে ৪ সদস্যের কমিটি গঠন করে মহানগর পুলিশ। কমিটিকে ৭ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। ওই কমিটি ১১ দিন পেরিয়ে গেলেও তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়নি। অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার সাইফুজ্জামান ফারুকী বলেছেন, আবু সাঈদের মৃত্যুর ঘটনায় যারাই দোষী প্রমাণিত হবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তদন্ত শেষ পর্যায়ে। রোববার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষার্থীরা জানান, আবু সাইদ আহত হয়ে পড়ে গেলেও পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়ক সাবিনা আক্তার বলেন, সাঈদকে ‘টার্গেট’ করে হত্যা করা হয়েছে।
ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় পড়ে গেলে সাইদের সহপাঠীরা তার কাছে ছুটে আসে। তারা আবু সাঈদকে রিকশায় তুলে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দিকে রওনা দেয়।
আবু সাঈদের মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশের এফআইআর নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে নতুন করে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক তুহিন ওয়াদুদ বলেন, আবু সাইদকে প্রকাশ্যে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডের ভিডিও ফুটেজ দেখেছে বিশ্ব। এখন পুলিশ অন্যদের দোষারোপ করার চেষ্টা করছে। এর মাধ্যমে পুলিশ প্রশাসনের প্রতি জনগণের আস্থা একেবারেই নষ্ট হবে।