সরকারের ঘাড়েই কোটার সিদ্ধান্ত চাপাল আদালত
কোটা নিয়ে আংশিক রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। রায়ে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটাসহ ৫৬ শতাংশ কোটা বাতিল করে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জারি করা পরিপত্রকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। নতুন রায়ে বলা হয়েছে, সরকার চাইলে কোটা বাড়াতে বা কমাতে পারে। কোটা পূরণ না হলে সাধারণ মেধা তালিকা থেকে নিয়োগ দেওয়া যাবে। এখন পর্যন্ত সরকার বিষয়টিকে আদালতের রায় বলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও এখন তা সরকারের কাঁধেই এসে পড়েছে। আর আদালত ছাত্রদের প্রতিপক্ষ না হয়ে সুকৌশলে সরকারের উপর ছেড়ে দিয়েছে তাদের রায়ের ইন্টেলেকচুয়াল ফ্যাক্ট
সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিলের দাবিতে এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সরকারের কাছে দাবি করা হচ্ছে, যদিও সরকার এ সমস্যা সমাধানে আদালতের ওপর নির্ভর করছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে পুরো ঢাকা শহর কার্যত অচল হয়ে পড়ে। সরকারের দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে, কোটার বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন থাকায় সেখানেই সমাধান করতে হবে। সরকার বিচারাধীন বিষয়ে কথা বলবে না।
চীন সফরের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সরকারি চাকরিতে কোটার বিষয়টি সর্বোচ্চ আদালতে নিষ্পত্তি করা উচিত। তিনি বলেন, ‘হাইকোর্টের রায়, এটার বিরুদ্ধে এভাবে আন্দোলন করা, এটা তো সাবজুডিস। কারণ, আমরা সরকারে থেকে কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো কথা বলতে পারি না। কারণ, হাইকোর্ট রায় দিলে সেটা হাইকোর্ট থেকেই আবার আসতে হবে।’
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘আদালত বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত দিয়ে রায় দেবেন। আদালতের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। এছাড়া শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীও বলেছেন, সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির বিষয়ে আদালতের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
অন্যদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম সম্প্রতি সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, কোটা আদালতের এখতিয়ারের মধ্যে নেই। তারা মূলত সরকারের নির্বাহী বিভাগের কাছে কোটা সমস্যার সমাধান চান।
তাই বাংলাদেশের সুপ্রীম কোর্টের এখতিয়ার সম্পর্কে সংবিধান কি বলে তা নিয়ে আরও আলোচনা করা প্রয়োজন। এ অবস্থায় সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও করপোরেশনে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে দুই গ্রেডে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্রকে অবৈধ ঘোষণা করে রায়ের মূল বা বাস্তবায়ন অংশ প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট।
বলা হয়েছে, এই রায় পাওয়ার তিন মাসের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ছাড়াও অন্যান্য কোটাও বহাল রাখতে হবে। তবে সরকার চাইলে বিভিন্ন কোটার হার কমাতে, বাড়াতে বা পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করতে পারবে। বৃহস্পতিবার (১১ জুলাই) বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন বলে জানিয়েছেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ সাইফুজ্জামান।
আন্দোলনকারীরা যে কোটা পদ্ধতির সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, তা এই রায়ে প্রশস্ত হয়েছে। রায়ে বলা হয়েছে, কোটা পূরণ না হলে সরকার মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে পারে।
এ প্রসঙ্গে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আজ রায়ের মূল অংশ যাকে অপারেটিভ পার্ট বলা হয়, তা প্রকাশ করা হয়েছে। উল্লেখ্য, কোটা পদ্ধতি বাতিল করে যে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল তা বাতিল করা হয়েছে। রায়ে বলা হয়েছে, উপজাতীয়দেরও মুক্তিযোদ্ধা কোটা, জেলা কোটা, নারী কোটাসহ তাদের কোটা থাকবে। তবে একটি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, সরকার পরিবর্তন করতে চাইলে তা করতে পারে।
কোটা পদ্ধতি সংস্কারের আহ্বান জানিয়েছে সরকারের উচ্চপর্যায়। দু-একদিনের মধ্যে সরকার নতুন সার্কুলার জারি করতে পারে। পরের দুই দিন সাপ্তাহিক ছুটি। আগামী সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে কোটা আন্দোলনকারীরা যাতে রাজপথে নামতে না পারে সেজন্য আগাম সমাধান করা হবে।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, পুলিশকে ‘ভুয়া ভুয়া’ বলে স্লোগান দিয়েধাক্কাধাক্কি করার পরও পুলিশ ধৈর্য্য ধারণ করেছে। তবে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সড়ক স্বাভাবিক রাখতে বললে ১০ মিনিটের মধ্যে সড়ক স্বাভাবিক করা যেত। কিন্তু পরবর্তীতে পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নেওয়ার আশঙ্কা করা হয়। এ কারণে পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
এই কর্মকর্তা আরও বলেন, যেহেতু সরকার কোটা সমস্যা যৌক্তিকভাবে সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছে, সে কারণেই পুলিশ অ্যাকশনে যায়নি। পরিস্থিতি শান্তভাবে সামাল দেওয়া হয়েছে। ব্যবস্থা নেওয়া হলে পুরো দায়ভার পুলিশের ওপর বর্তাবে। এমনিতেই পুলিশের ওপর ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ। পুলিশ যথাযথ বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে। তবে আইন ভঙ্গকারীদের ছাড় দেওয়া হবে না।
উল্লেখ্য, কোটা সংস্কার আন্দোলনের মুখে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে নবম থেকে ১৩ তম গ্রেড পর্যন্ত কোটা পদ্ধতি বাতিল করে গত ৪ অক্টোবর পরিপত্র জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ২০২১ সালে, চাকরি প্রত্যাশী এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাত সন্তান এই বিজ্ঞপ্তির বৈধতা সম্পর্কে একটি পিটিশন দাখিল করেছিলেন। চূড়ান্ত শুনানি শেষে গত ৫ জুন বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ নির্দেশনাসহ রুলটিকে নিরঙ্কুশ (যথাযথ) ঘোষণা করে রায় দেন।