মানুষ কেন শহরমুখী?
কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসহ বিলাসবহুল নাগরিক জীবনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে মানুষ শহরগুলোর দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন দুর্যোগে গৃহহীন মানুষও শহরে ভিড় জমায়। দেশে গ্রামীণ এলাকা থেকে শহরাঞ্চলে অভিবাসনের হার দিন দিন বাড়লেও সম্প্রতি তা উল্লেখযোগ্য হারে কমছে।
মানুষ গ্রামে যায়, কিন্তু আবার দ্রুতই ফিরে আসে। কিন্তু শহরে ফিরে আসে কেন? এই প্রশ্নের জবাবে জরিপে বেশ কিছু ঘাটতি প্রকাশ পেয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কার্যকর গণপরিবহন ব্যবস্থা, উন্নত গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণ, মানসম্পন্ন ভোগ্যপণ্যের প্রবেশাধিকার, কৃষি পণ্যের বিপণন, বাজারের উন্নয়ন, স্যানিটেশন পরিস্থিতি, বিশুদ্ধ পানির সুবিধার অভাব, প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঋণ সুবিধা না পাওয়া, বা অপর্যাপ্ততা। বিনোদনমূলক সুবিধা, সাশ্রয়ী মূল্যের চিকিৎসা সেবার অনুপলব্ধতা, কারিগরি শিক্ষার সুযোগের অভাব ইত্যাদি।
দেশে শহুরে মানুষের সংখ্যা অস্বাভাবিক গতিতে বাড়ছে। বর্তমানে দেশের ৩৩ শতাংশ মানুষ শহরে বাস করে। বিশেষ করে ঢাকা শহরে এই হার মাত্রাতিরিক্ত। বড় শহর ছাড়া আর কোনো নাগরিক সুযোগ-সুবিধা না থাকায় দেশের প্রতিটি প্রান্ত থেকে মানুষ শহরমুখী হচ্ছে। বর্তমানে ৫ কোটিরও বেশি মানুষ শহরে বাস করে। ফলে সেবা সংস্থাগুলো নাগরিকদের প্রয়োজনীয় সেবা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। এতে নগরীর পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা হচ্ছে না। রাজধানী ঢাকাকে বসবাসের অযোগ্য শহর হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। তারপরও ঢাকার দিকে মানুষের স্রোত থামছে না। পদ্মা ও যমুনা নদীর ওপর সেতু নির্মাণ হলেও রাজধানী ছাড়া অন্য এলাকায় কর্মসংস্থান হচ্ছে না।
গ্রামগুলোতে শহরের সুবিধা নিশ্চিত করতে সরকার মাই ভিলেজ মাই টাউন প্রকল্প হাতে নিলেও অগ্রগতির চিত্র সন্তোষজনক নয়। ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকা থেকে প্রতিনিয়ত কৃষি জমি, জলাশয় ও হ্রদ ভরাট করে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হচ্ছে। নগর গবেষকরা দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় নগরনীতি প্রণয়নের দাবি জানিয়ে আসছেন, কিন্তু তা আলোর মুখ দেখেনি। ফলে ঢাকা শহর উন্মুক্ত বস্তিতে পরিণত হতে যাচ্ছে। এ অবস্থার অবসান ঘটাতে দ্রুত বিকেন্দ্রীকরণের বিকল্প নেই।
সেন্টার ফর আরবান রিসার্চের ৫২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে শনিবার রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমিতে আয়োজিত দিনব্যাপী ‘বাংলাদেশে নগরায়ন ও নগর পরিবেশ’ শীর্ষক সম্মেলনে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এ অভিমত ব্যক্ত করেন। অনুষ্ঠানের তিনটি অংশে বিশেষজ্ঞ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা পাঁচটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। এসব প্রবন্ধে ঢাকা শহরের বাসযোগ্যতার ভঙ্গুর চিত্র ফুটে উঠেছে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম
শহরের দিকে মানুষের প্রবাহ বাড়ছে। আরবান রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান ইমেরিটাস অধ্যাপক অধ্যাপক নজরুল ইসলাম তার বাংলাদেশের নগরায়ন এবং ঢাকার প্রাধান্য’ শীর্ষক প্রবন্ধে বলেছেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের সূচনাকালে ৭ শতাংশ মানুষ শহরে বাস করত। ২০০১ সালে এটি ছিল ২৩.১০ শতাংশ। ২০২২ সালে এটি দাঁড়িয়েছে ৩১.৫১ শতাংশে। এই জনসংখ্যা ৫ কোটি ২০ লাখ ১০ হাজার। ২০৪১ সালের মধ্যে, শহুরে জনসংখ্যা ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে।
ইতোমধ্যে ঢাকা তার বসবাসযোগ্যতা হারিয়েছে , এক সময়ের পুরানো শহরের আভিজাত্য এবং নতুন ভবনগুলির সহজ সৌন্দর্য ঢাকাকে একটি সুন্দর শহরে পরিণত করেছিল। বর্তমানে, বসবাসযোগ্যতার দিক থেকে শহরটি বিশ্বের ১৪০ টি শহরের মধ্যে ১৩৭ তম স্থানে রয়েছে। ঢাকা মহানগরীর ৬২ শতাংশ জমিতে শুধু দালান-কোঠা। এর মধ্যে ৩৭ শতাংশই অপরিকল্পিত আবাসন ঘটেছে । যানজট, পরিবেশ দূষণের ফল ভোগ করতে হচ্ছে। নানা সমস্যায় জর্জরিত ঢাকা শহর বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে।
গত সাত বছরে রাজধানীর তাপমাত্রা বেড়েছে ৩ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০১৭ সালে ঢাকার গড় তাপমাত্রা ছিল ৩৩.০৪ ডিগ্রি। এ বছর তা ৩৬.৯৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছেছে। রাজধানীতে বর্তমানে আরেকটি হুমকি মিথেন গ্যাস। ঢাকার মাতুয়াইলের স্যানিটারি ল্যান্ডফিল থেকে বিপুল পরিমাণ মিথেন গ্যাস বের হয়েছে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, শুধু বাংলাদেশ নয় বড় দেশগুলোও শহরমুখী অভিবাসনের এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে। ঢাকা শহরকে বাসযোগ্য করে তুলতে হলে পরিকল্পিতভাবে কাজ করতে হবে। জোর করে নগরায়ন বন্ধ করা যাবে না। ছোট শহরগুলোতে গ্যাস-পানি না দিতে পারলে গাজীপুরে চাপ সৃষ্টি করে কারখানা নির্মাণ বন্ধ করা যাবে না। এখন মানুষের আয় বেড়েছে। সরকারি কর্মচারীদের বেতনও বেড়েছে। এ কারণে ঢাকার বাইরে কেউ থাকতে চায় না। মানুষকে শহরে বসবাসে নিরুৎসাহিত করতে গুলশান-বনানীর মতো জায়গায় পানি, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কথা ভাবা হচ্ছে। পরিকল্পিত নগরায়নের জন্য দ্রুত একটি জাতীয় নগর নীতি প্রণয়ন করা হবে।
অর্থনীতিবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক আতিউর রহমান বলেন, শহর শুধু ভূমি ব্যবস্থা নয়। এছাড়া জাতি গঠনের জন্য মানসিক স্বাধীনতা থাকতে হবে। কিন্তু যেভাবে নগরীর উন্নয়ন হচ্ছে, তাতে একে আদর্শ শহর বলা যাবে না।
আমরা সব সময়ই বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলে আসছি। ইউনিয়ন, উপজেলা, পৌরসভা শক্তিশালী হলে স্বয়ংক্রিয় বিকেন্দ্রীকরণ ঘটবে।