শেখ হাসিনার বক্তব্য প্রত্যাখ্যান: কোটা প্রথা বিরোধী আন্দোলনকারী মেধাবীদের ‘বাংলা ব্লকেড’
একদিকে মেধাবী ছাত্রদের উত্তাল আন্দোলন, আরেক দিকে সরকারের অভ্যাসে পরিণত হয়ে যাওয়া, পার পেয়ে যাওয়া, আদালত থেকে রায় নিয়ে আসার প্রবণতার প্রতিফলন। আর কোটা প্রথায় আশীর্বাদ-পুষ্ট কটিপয় ছাত্র। চলছে মেধাবীদের বাংলা ব্লকেড।
চলমান কোটা আন্দোলন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। রোববার (৭ জুলাই) কোটা আন্দোলনের একাধিক সমন্বয়কারী এসব কথা বলেন।
সকালে গণভবনে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘আন্দোলনের নামে পড়াশোনার সময় নষ্ট করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। হাইকোর্ট রায় দিয়েছেন, সমাধান হাইকোর্ট থেকেই আসতে হবে। ’
কোটা আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ও ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, প্রধানমন্ত্রীর আরেকটু চিন্তা করে এ ধরনের কথা বলা উচিত ছিল। আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মান করছি না। আমরা পোষ্য কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন করছি। আমরা প্রতিবন্ধী ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা চাই। কিন্তু এত কোটা মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তান ও নাতি-নাতনিদের জন্য আশাব্যঞ্জক নয়। আমরা এর যৌক্তিক সংস্কার চাই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সমন্বয়ক ও শিক্ষার্থী মাহিন সরকার বলেন, ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনে আমরা কোটা বিলুপ্ত করতে চাইনি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সংসদকে অসম্মান করে পরিপত্র জারি করলে এর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। সংসদ আজ প্রধানমন্ত্রীর এ ধরনের বক্তব্য আমাদের কাছে হঠাৎ মনে হচ্ছে। আমরা এই বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করছি।
বাংলা বিভাগের আন্দোলনরত শিক্ষার্থী মোসাদ্দেক বলেন, আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আশার বাণী শুনতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তার দেওয়া বক্তব্যে ছাত্রসমাজ চরমভাবে হতাশ হয়।
কোটা সংস্কার ও মেধাভিত্তিক নিয়োগের জন্য ২০১৮ সালের সরকারি সার্কুলার পুনর্বহালের দাবিতে আন্দোলন করছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। ৫ জুন হাইকোর্ট ২০১৮ সালের সার্কুলারকে অবৈধ ঘোষণা করার পর আবারও আন্দোলন শুরু হয়। বাতিলের দাবিতে রোববার (৭ জুলাই) বিকেলে সারাদেশে সড়ক-মহাসড়ক অবরোধের ডাক দেয় শিক্ষার্থীরা। শাহবাগ মোড়সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এই কর্মসূচির নামকরণ করেন‘বাংলা ব্লকেড’ (বাংলা অবরোধ)।
গতকাল শনিবার (৬ জুলাই) শাহবাগে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি ঘোষণা করেন তারা। বাঙালি অবরোধের ব্যাখ্যায় তারা বলেন, রোববার (৭ জুলাই) সারাদেশের গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়ক অবরোধ করে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। অবরোধের কারণে কোনো যানবাহন ঢাকায় প্রবেশ করতে পারছে না । তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন, আমরা চাই তা মেধাবীদের হাতে তুলে দেওয়া হোক।
তিনি বলেন, আদালতের দেওয়া রায় সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সংবিধানের কোথাও কোটা শব্দটি উল্লেখ নেই। সংবিধানে সব সরকারি চাকরিতে সুযোগের সমতার বিধান রয়েছে। সেখানে দাঁড়িয়ে আদালতের এই রায় কোনোভাবেই ন্যায়বিচার হতে পারে না। তাই ছাত্রসমাজ রাজপথে আন্দোলন করেই কোটা পদ্ধতির সংস্কার করে সব ধরনের বৈষম্য দূর করবে।
খুবই দুঃখজনক বিষয়। আমাদের সন্তানদের এখন বই পড়া বন্ধ করে রাস্তায় নামতে হবে। যারা মেধাবী তারা চাকরি পাবে এটাই স্বাভাবিক। এটি একটি আধুনিক রাষ্ট্রীয় নীতি হওয়া উচিত যে ,সরকার ভাতা দেবে বা রাষ্ট্র তাদের পুনর্বাসন করবে যাদের কোন কারণে কোটা দরকার। একজন মুক্তিযোদ্ধা দেশের জন্য জীবন বাজি রেখেছিলেন, আশা করা যায় দেশ এখন তার সব চাহিদা সসম্মানে পূরণ করবে। কিন্তু তার সন্তান মেধাবী না হলে রাষ্ট্রের দায়িত্ব নয়, প্রয়োজনে রাষ্ট্রের উচিত তাকে লেখাপড়ার ভাতাও দেওয়া। কিন্তু প্রতিভাকে অবমূল্যায়ন করা কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নয়। এক পদে অযোগ্য লোক নিয়োগ দিলে রাষ্ট্রের প্রচুর অর্থ অপচয় হবে, অন্যদিকে মেধা চর্চাও বন্ধ হবে।
ছাত্রলীগের বাধা উপেক্ষা করে আন্দোলনে থাকা শিক্ষার্থীরা
ছাত্রলীগের বাধা উপেক্ষা করে কোটাবিরোধী আন্দোলনে আসছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। হলপাড়া এলাকার শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন একত্রে এই আন্দোলনে অংশ নিচ্ছে। আন্দোলনে অংশ নিতে সূর্যসেন হলের শিক্ষার্থীদের তৈরি করা ব্যানার ছিঁড়ে ফেলেন ছাত্রলীগের কর্মীরা। কিন্তু আবারও শিক্ষার্থীরা চাঁদা সংগ্ৰহ করে ব্যানার তৈরি করে কোটাবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিচ্ছে বলে জানিয়েছেন সূর্যসেন হলের শিক্ষার্থীরা।
নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য
কোটা বিরোধী আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য। প্রতিদিন নারী শিক্ষার্থীরা তাদের হল থেকে আলাদা হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে একটি বড় মিছিলে জড়ো হয়। মেয়েরা প্রতিদিন মিছিলের প্রথম সারিতে অবস্থান নেয়। শাহবাগে কোটাবিরোধী স্লোগান, বিদ্রোহী গান ও কবিতা আবৃত্তিতে মেয়েদের অংশগ্রহণ লক্ষণীয়। আন্দোলনের স্থানীয় নেতারা জানান, প্রথম দুই দিন মহিলা হলের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ কম ছিল। তারা ভয়ে শুরুতে আসেনি। কিন্তু এখন সব হল থেকে মেয়েরা উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ পাচ্ছে।
কোটা বাতিল না হওয়া পর্যন্ত তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন বলে জানান
ঢাকা কলেজের ছাত্র নাজমুল হাসান বলেন, এটা আমাদের পূর্বঘোষিত কর্মসূচি। এর আগেও আমরা টানা চার দিন কলেজের প্রধান ফটকে অবস্থানসহ বিভিন্ন কোটাবিরোধী কর্মসূচি পালন করেছি। আমাদের দাবি একটাই, কোটা বাতিল করা হোক।
তিনি বলেন, “সংবিধানে সমতা রক্ষার কথা বলা আছে। কিন্তু কোটার মাধ্যমে বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে। ছাত্র সমাজের দাবির প্রেক্ষিতে একটি বিশেষ শ্রেণিকে যে সুবিধা দেওয়া হচ্ছে তা বাতিল করতে হবে। অন্যথায় সারাদেশে ছড়িয়ে পড়া এই আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হবে।”
শাহবাগে শিক্ষার্থীরা ‘হাই কোর্ট না শাহবাগ-শাহবাগ, শাহবাগ’, ‘১৮ এর হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার,’ ‘কোটা না মেধা- মেধা মেধা’, ‘সারা বাংলায় খবর দে, কোটা প্রথার কবর দে’, ‘১৮ এর পরিপত্র পুনর্বহাল করতে হবে’, ‘সংবিধানের মূল কথা সুযোগের সমতা’, ‘কোটা প্রথা নিপাত যাক, মেধাবীরা মুক্তি পাক’সহ ইত্যাদি স্লোগান দেন।
শাহবাগে ব্লকেড কর্মসূচিতে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, “চার দফা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে।”
(১) ২০১৮ সালে ঘোষিত সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিল ও মেধাভিত্তিক নিয়োগের পরিপত্র বহাল রাখতে হবে।
(২) ২০১৮ সালের পরিপত্র বহাল সাপেক্ষে কমিশন গঠন করে দ্রুত সময়ের মধ্যে সরকারি চাকরিতে (সকল গ্রেডে) অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাদ দিতে হবে এবং কোটাকে ন্যূনতম পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। সেক্ষেত্রে সংবিধান অনুযায়ী কেবল অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনা করা যেতে পারে।
(৩) সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় কোটা সুবিধা একাধিকবার ব্যবহার করা যাবে না এবং কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে শূন্য পদগুলোতে মেধা অনুযায়ী নিয়োগ দিতে হবে।
(৪) দুর্নীতিমুক্ত, নিরপেক্ষ ও মেধাভিত্তিক আমলাতন্ত্র নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।