পরিবেশ রক্ষায় সাপ: প্রাণীবিদদের মতামত
সাপ এই চক্রে কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণের একটি প্রাকৃতিক রূপ। কারণ শিকারী হিসাবে, সাপ যে প্রাণীগুলি খায় তার ভারসাম্য বজায় রাখে।প্রাণিবিদরা বলছেন, একশো বছর আগেও এই এলাকায় রাসেল ভাইপার ছিল। এখন এই সাপ বৃদ্ধির কারণ বাস্তুতন্ত্রের পরিবর্তন।
অর্থাৎ যে প্রাণীগুলো রাসেল ভাইপারদের খেয়েছে তাদের সংখ্যা এখন কমে গেছে। যেমন: গুইসাপ, বেজি, চিল, ঈগল, গণ্ডগোকুল বিভিন্ন প্রাণীর সংখ্যা কমে গেছে । ফলে সাপের সংখ্যা বেড়েছে।
অধ্যাপক মোঃ ফরিদ আহসান আরও বলেন, “রাসেলের ভাইপারের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণ বাস্তুতন্ত্রের পরিবর্তন। তাদেরকে খাওয়া প্রাণীর সংখ্যা কমেছে। ফলে এই সাপের সংখ্যা বেড়েছে।”
পরিবেশে সাপ মারার প্রভাব
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকৃতির অংশ হিসেবে সাপ হত্যা পুরো বাস্তুতন্ত্রকে প্রভাবিত করবে। ফসলের ক্ষেতে সাপ মারলে ইঁদুরের প্রভাব বাড়বে। সাধারণত প্রতি বছর ইঁদুর দ্বারা ১০ থেকে ২০% ফসল নষ্ট হয়ে যায়। ফলে নির্বিচারে সাপ নিধন করলে ইঁদুরের সংখ্যা বাড়বে। ফসল উৎপাদন কমে যাবে।
বন বিভাগের প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমির হোসেন চৌধুরী বলেন, “সাপ ব্যাঙ ও ইঁদুর খায়। বেজি, বাগদাশ, গণ্ডগোকুল, বনবিড়াল সাপ খায়। আবার শঙ্খচুদ, গোখরা, কেউটের মতো এসব সাপ রাসেলের ভাইপারসহ অন্যান্য সাপকেও খায়। সাপ ইঁদুর খায় ফসল খেতে। তারা ইঁদুর খেয়ে ফসলের উপকার করে। এভাবে বিপুল সংখ্যক সাপ মারা গেলে এক শ্রেণীর শিকারী কমে যাবে।”
তিনি আরও বলেন, “কারণ তাহলে ভবিষ্যতে ইঁদুর বাড়বে। তারা খাবে এবং ফসল নষ্ট করবে। ফসল উৎপাদন কমে যাবে। যা খাদ্য চক্রকে প্রভাবিত করবে। এভাবে সাপ মেরে ফেললে ভবিষ্যতে অনেক ক্ষতি হবে।”
রাসেল ভাইপার মানব বসতি এড়িয়ে চলে
বাংলাদেশে সাপ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার কারণে এ ধরনের প্রাণী নির্বিচারে হত্যা করা হয়। তবে বাস্তুতন্ত্রে সাপের ভূমিকা অন্য কেউ পালন করতে পারবে না বলে জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোঃ আমিনুল ইসলাম ভূইয়া।
তিনি বলেন, “বাস্তুতন্ত্রে সাপের ভূমিকা প্রতিস্থাপন করা যায় না। এই সিস্টেমের প্রতিটি জীব অন্যকে প্রভাবিত করে। ফলস্বরূপ, সাপের অভাবের কারণে মোট খাদ্য শৃঙ্খল প্রভাবিত হবে।”
এদিকে, বন্যপ্রাণী আইন ২০১২-এর অধীনে রাসেল ভাইপারকে একটি সংরক্ষিত প্রজাতির তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এই আইনটি রাসেল ভাইপারকে হত্যা করা, ধরা এবং বহন করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ প্ৰমাণ করে।
চার হাজারের বেশি সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা করা ড. ফরহাদ উদ্দিন হাসান চৌধুরী বলেন, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক অনিরুদ্ধ ঘোষের নেতৃত্বে একদল গবেষক গত ৪-৫ বছর ধরে আমাদের দেশে এই সাপের বিরুদ্ধে কার্যকর অ্যান্টিভেনম তৈরিতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। আশা করি আমরা অদূর ভবিষ্যতে রাসেল ভাইপারের বিরুদ্ধে কার্যকর একটি দেশীয় অ্যান্টিভেনম পেতে পারব।
তিনি বলেন, আমি নিজে আমার জীবনে ৩০০০-৪০০০ টিরও বেশি সাপের কামড় রোগীর চিকিৎসা করেছি, বিষাক্ত এবং অ-বিষাক্ত উভয়ই মিলে। আমি কোবরা, ক্রেইট, রাসেল ভাইপার সহ সব ধরনের সাপের কামড়ের চিকিৎসা করেছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত রাসেলের ভাইপারের ক্ষেত্রে ৫০% এর বেশি রোগীকে বাঁচানো যায় না। তবে আমি মনে করি যে রোগী আক্রমণের পরে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাসপাতালে আসতে হবে ,আর অবিলম্বে অ্যান্টিভেনম শুরু করে এবং ডায়ালাইসিস, ভেন্টিলেশন ইত্যাদি সহায়ক চিকিত্সা দেয় তবে তাকে বাঁচানো সম্ভব।
আমরা সাধারণত সাপের কামড় ব্যান্ডেজ করি, কিন্তু যদি রাসেল ভাইপারের কামড় নিশ্চিত হয়, তবে আক্রান্ত স্থানটি বাঁধা বা ব্যান্ডেজ করা নিষিদ্ধ কারণ ব্যান্ডেজটি অত্যধিক ইনট্রা-পেশীবহুল রক্তপাত ঘটাতে পারে যা অঙ্গচ্ছেদের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
সাপ মেরে শেষ করা যায় না। ব্রিটিশ আমলে সরকারের উদ্যোগে সাপ নিধনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং যথারীতি অনেক সাপ মেরে ফেলা হলেও সাপের কামড়ের সংখ্যা বা সাপের বংশবৃদ্ধি কমেনি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে সাপের কামড়ের চেয়েও বড় স্বাস্থ্য সমস্যা রয়েছে। সেপসিস নামক রোগে বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ২ লাখ মানুষ মারা যায়, সংক্রমণে অ্যান্টিবায়োটিক কাজ না করার কারণে মারা যায় হাজার হাজার মানুষ, গত বছর ডেঙ্গুতে মারা যায় ১৭০০ মানুষ। দেশে প্রতি বছর সাপের কামড়ে ৬ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়। এদের অধিকাংশই প্রান্তিক মানুষ। সচেতনতার অভাবে অধিকাংশ মানুষ হাসপাতালে না গিয়ে ওঝার কাছে গিয়ে মারা যায়। বর্ধিত সচেতনতা, দ্রুত হাসপাতালে প্রবেশ এবং সময়মতো অ্যান্টিভেনম প্রশাসনের উপর আশা। বর্ষা ও বর্ষা-পরবর্তী মৌসুমে সাপের কামড় বেড়ে যায় তাই এখনই সতর্ক হওয়া বেশি জরুরি।
আরও জানুন
ঘুমের মধ্যে নির্বিঘ্নে পেটে ঢুকে যায় সাপটি, তরুণীর পেট থেকে বের হলো ৪ ফুট লম্বা সাপ