ইয়াবা-খোর হত্যাকারী পুলিশ কাউসার ঘুমায় নাই পাঁচ দিন
ঘুষ, দুর্বৃত্তায়ন ক্ষমতার অপব্যবহার, সর্বোচ্চ কর্মকর্তাদেরও চারিত্রিক অধঃপতন সহকারে পুলিশের এহেন কর্মকান্ডে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ পুলিশকে কোন চোখে দেখে তা বলার অপেক্ষা রাখে না । তাই পুলিশরা ইয়াবা খাবে আর খাবে না সেটাও এখন মানুষের কাছে কোন ব্যাপার না। আসল কথা হচ্ছে পুলিশ একপর্যায়ে সরকার হয়ে যায়, আর সরকার হয়ে যায় পুলিশ । এটাই চলছে এই সোনার বাংলাদেশে।
রাজধানীর বারিধারায় ফিলিস্তিন দূতাবাসের সামনে সহকর্মী মনিরুল ইসলামকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যার আগে মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছিলেন কনস্টেবল কাউসার আহমেদ। এছাড়া সে নিয়মিত ইয়াবা সেবন করতো। মনিরুলকে হত্যার আগে টানা পাঁচ দিন ঘুম হয়নি কাউসারের। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধূমপান করতেন। ঘটনার দিন ডিউটি রোস্টারে তার নাম পাওয়া যায়। কিন্তু সে কারণে তিনি মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছিলেন এবং মনিরুলের প্রতি তার কী রাগ ছিল তা প্রকাশ করেননি। সোমবার তাকে সাত দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন তদন্তকারীরা।
গতকাল ছিল রিমান্ডের প্রথম দিন। হত্যার কারণ জানতে চাইলে কাউসার তার ঊর্ধ্বতনদের জানান, তর্কের জেরে মনিরুলকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। তবে কী নিয়ে তর্ক-বিতর্কে জড়িয়েছেন তা জানাননি তিনি। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র গতকাল এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছে।
অন্যদিকে, স্পর্শকাতর এলাকার কূটনৈতিক কোয়ার্টারে ইয়াবায় আসক্ত ও মানসিক ভারসাম্যহীন এক কনস্টেবলকে নিয়োগ দেওয়া নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। অনেকে বলেন, কাউসারের সমস্যা দীর্ঘদিনের। সব কিছু জানার পরও কীভাবে তাকে এই স্পর্শকাতর এলাকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তা নিয়ে পুলিশ সুপারদের মধ্যে চলছে আলোচনা-সমালোচনা।
কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, কাউসার এখানে আরও ভয়াবহ ঘটনা ঘটাতে পারত। তার প্রোফাইলে স্পষ্টভাবে সবকিছু উল্লেখ রয়েছে । কিন্তু কেন তাকে এত স্পর্শকাতর এলাকা দেওয়া হলো?
ডিএমপি সূত্র জানায়, কাউসার আহমেদ আগে থেকেই ‘মানসিক রোগী’ ছিলেন। এ কারণে তাকে তিনবার পাবনা মানসিক হাসপাতালে ডিএমপির পক্ষ থেকে চিকিৎসা দেওয়া হয়। কাউসার আলীর পরিবারও তাকে মানসিক রোগী বলে দাবি
করছেন । সংবেদনশীল এলাকায় এমন ‘মানসিক রোগী’ রাখা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কোনো পুলিশ সদস্য বা কর্মকর্তা মানসিকভাবে অসুস্থ বা শারীরিকভাবে অসুস্থ বা মানসিক চাপে থাকলে তাকে সম্পূর্ণ সুস্থতার জন্য ছুটিতে পাঠানোর নিয়ম রয়েছে। তা হলে কূটনৈতিক অঞ্চলের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর স্থানে কেন ‘অসুস্থ’ পুলিশ সদস্যকে ডিউটি দেওয়া হলো, তা খতিয়ে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
ডিএমপি সূত্র জানায়, স্পর্শকাতর এলাকায় দায়িত্ব পালনকারী পুলিশ কর্মকর্তা-সদস্যদের তল্লাশি শেষে পদায়ন করা হয়। শারীরিক ও মানসিকভাবে শক্তিশালী পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যদের পদায়ন করা হয়েছে। এখানে দায়িত্বগুলোকে রোস্টার পদ্ধতিতে ভাগ করা হয়েছে।
গুলশান থানার ওসি মাজহারুল ইসলাম জানান, কনস্টেবল মনিরুল গুলি ও হত্যা মামলায় কাওসারকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিভিন্নভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন। তবে কী কারণে মনিরুলের শুটিং হয়েছে সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দেননি কাউসার। আশা করছি শিগগিরই হত্যার কারণ বেরিয়ে আসবে।
এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গতকাল সচিবালয়ে নিজ দফতরে সাংবাদিকদের বলেন, পুলিশের কোনো গাফিলতি ছিল কিনা তা খতিয়ে দেখা হবে। চাঞ্চল্যকর মনিরুল হত্যা মামলায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) রিফাত রহমান শামীম ছাড়াও কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন কূটনৈতিক নিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) এলিন চৌধুরী ও ডিএমপির সহকারী পুলিশ কমিশনার আসফাক হোসেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমরা যতদূর জানি, কথোপকথন, তারপর শুটিং, তার কাছে একটি এসএমজি ছিল। এসএমজি দিয়ে গুলি চালায়। এটা খুবই দুঃখজনক এবং অপ্রত্যাশিত ঘটনা। ঘটনা শুনে আমরা সবাই সত্যিই হতবাক হয়ে গেলাম- কেন একজন কনস্টেবল আরেক কনস্টেবলকে হত্যা করবে।
তিনি বলেন, একটি কমিটি গঠন করে মামলা করা হয়েছে। তাকে এখন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তদন্ত করলেই প্রকৃত ঘটনা জানা যাবে বলে আমি মনে করি। এখন আমি যাই বলি না কেন, অনুমানের উপর ভিত্তি করে কথা বলব বা কারো কথা শুনে কথা বলব। তদন্ত সাপেক্ষে আমরা পুরো বিষয়টি জানাতে পারব।
মিস্টার খান সাহেব বলেন, এখন পর্যন্ত যা শুনেছি, তার পারিবারিক কোনো সমস্যা বা অন্য কিছু থাকতে পারে। তাই আমরা এখনই কিছু বলতে পারছি না। আমরাও উদ্বিগ্ন যে একজন পুলিশ কী কারণে তিনি গুলি চালালেন। আমরা অবশ্যই বিষয়টি তদন্ত করব। কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে বা অনিচ্ছাকৃতভাবে এটি করেছে কিনা বা কেন এটি ঘটেছে – আমরা এই সব দেখব।
মনিরুলের মা বারবার অজ্ঞান হয়ে পড়ছেন
নেত্রকোনার আটপাড়া উপজেলার বিষ্ণুপুরে সহকর্মীর গুলিতে নিহত পুলিশ কনস্টেবল মনিরুল হকের (২৭) গ্রামের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। বিষ্ণুপুর গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মৃত শামসুল হকের ছয় সন্তানের মধ্যে মনিরুল ছিলেন সবার ছোট। ছেলের শোকে মনিরুলের বৃদ্ধা মা দিলারা হক বারবার অজ্ঞান হয়ে পড়েন। স্ত্রী তানিয়া আক্তার তানভী তার দুই বছরের ছেলে ত্বকীকে জড়িয়ে ধরে হাহাকার করছেন। কাঁদছেন মনিরুলের বড় ভাই আমিনুল হক মিঠু। মনিরুলের দুই বছরের ছেলে তখনও কিছুই বুঝতে পারছে না।
মনিরুলের শোকসন্তপ্ত পরিবারকে সান্ত্বনা দিতে প্রতিবেশী ও স্বজনরা বাড়িতে ভিড় করেন। সবার চোখে ছিল কান্নাশ্রু। কারো মুখে ভাষা নেই। গ্রামবাসী ও স্বজনরা মনিরুল হত্যার নিন্দা জানিয়ে দ্রুত হত্যাকারীর বিচার দাবি করছেন।
অপরদিকে সোমবার সকালে স্থানীয় ঈদগা মাঠে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে মনিরুলের দাফন সম্পন্ন হয়।