অপরাধ ক্রমাগত বেড়েই চলছে বাংলাদেশে
অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণ করা এবং অপরাধ কমিয়ে আনার চেষ্টা করায় যে বাহিনী তারাই পুলিশ বাহিনী। সে পুলিশ বাহিনী যখন রাষ্ট্রের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রক হয়ে পড়ে; তখন অপরাধ না কমে সে রাষ্ট্রে অপরাধ বাড়তেই থাকে। আর সেটাই ঘটছে বাংলাদেশে ।
পুলিশ বাহিনীতে জনবল বাড়ে, আধুনিক প্রযুক্তি যুক্ত হয়। কিন্তু অপরাধ কমছে না। উল্টো বাড়ছে । এতে যোগ হচ্ছে অপরাধের নতুন নতুন রূপ। আর এই সময়ে পুলিশের মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে কিশোর গ্যাং যন্ত্রণা ।
পুলিশ সদর দফতরের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালে দেশে খুন হয়েছে ৩ হাজার ২৮টি এবং ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৫ হাজার ২০২টি।
ছিনতাই, চোরাচালান ও অপহরণের মতো প্রচলিত অপরাধ বাড়ছে। হত্যা, ধর্ষণ, নারী নির্যাতনের মতো অপরাধ কমছে না। অনলাইনে প্রতারণা, ই-কমার্সের নামে প্রতারণা, অনলাইন জুয়ার মতো অপরাধ পুলিশকে নতুন ভাবনা দিচ্ছে। আবার এক শ্রেণীর পুলিশ সদস্য নিজেরাই অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সামাজিক অস্থিরতা এর অন্যতম কারণ। একইভাবে পুলিশ এখন অপরাধ দমন ছাড়াও আরও অনেক কাজে যুক্ত হচ্ছে। এ ছাড়া বিচারহীনতার সংস্কৃতিও একটি বড় কারণ বলে মনে করেন তারা।
তবে পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, তারা বেশ কিছু অপরাধ নিয়ন্ত্রণে এনেছেন। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তি অপরাধীদের বেপরোয়া করে তুলেছে। যদিও পুলিশ কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে।
গত বছর সারাদেশে বিভিন্ন অপরাধে মোট ১ লাখ ৯৫ হাজার ৪৩৬টি মামলা হয়েছে। গত বছর দুই লাখের বেশি মামলা হয়েছে। আর ২০২১ সালে ১ লাখ ৯৭ হাজারের বেশি।
পুলিশ সদর দফতরের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালে দেশে খুন হয়েছে ৩ হাজার ২৮টি এবং ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৫ হাজার ২০২টি। প্রতিদিন গড়ে আটটি খুন ও ১৪টির বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। আর ওই বছর নারী নির্যাতনের মামলা হয় ১১ হাজার ৩৭টি। প্রতিদিন পুলিশের কাছে নারী নির্যাতনের ৩০টির বেশি অভিযোগ এসেছে।
২০২১ সালে ডাকাতির ঘটনা ঘটে ৯৭১টি। সেখানে ২০২২ সালে ১ হাজার ১২৮টি এবং ২০২৩ সালে এক হাজার ৩৮৪ টি ডাকাতির ঘটনা পুলিশ রেকর্ড করেছে।
২০২২ সালে অপহরণের মামলা হয়েছে ৪৬৩টি আর ২০২৩ সালে ৪৬৬টি।
২০২৩ সালে চোরাচালানের মামলা হয়েছে ২ হাজার ৫০০টি আর ২০২২ সালে মামলা ২১৪ টি কম ছিল। মোট মামলার সংখ্যা ছিল ২ হাজার ২৪৬টি।
পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ সালে দেশে চুরি, দ্রুত বিচার, ডাকাতি, এসিড নিক্ষেপ ও মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনে মোট ৮৯ হাজার ৮০৯টি মামলা হয়েছে। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ৯৬ হাজার ৬২২।
২০২৩ সালে, একমাত্র মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনেই সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে। এ বছর সারাদেশে মাদক সংক্রান্ত মামলা হয়েছে ৭৬ হাজার ৪১৮টি। গত বছর এ আইনে ৮২ হাজার ৬৭২টি মামলা হয়েছে।
দেশের রাজধানী ঢাকায় অপরাধ সবচেয়ে বেশি। ২০২৩ সালে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাছে বিভিন্ন অপরাধের ২৫,০৪৯টি মামলা রিপোর্ট করা হয়েছে।
ডিএমপির এক কমিশনার বলেন, বছরের পরিসংখ্যান আসলে উত্থান-পতন। কখনো বাড়ে, কখনো কমে। তবে পরিসংখ্যানের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো উপলব্ধি। মানুষ কী ভাবছে? মানুষ আগের চেয়ে বেশি নিরাপত্তাহীন বোধ করছে। নিরাপদ বোধ না করলেও তারা যে খুব খারাপ মনে করে এই ধরনের তথ্য কিন্তু আমাদের কাছে নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক মনে করেন, যখন অপরাধের বাণিজ্য হয়, তখন পুলিশে জনবল বাড়ালেও অপরাধ নিয়ন্ত্রণ বা কমানো যায় না। এখানে বিভিন্ন অপরাধী গোষ্ঠীর সঙ্গে দুর্বৃত্ত পুলিশের একাংশের যোগাযোগের অভিযোগ রয়েছে। আবার পুলিশ নিজেই অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
তার ভাষায়, ‘পুলিশ আইনশৃঙ্খলা ও অপরাধ নিয়ন্ত্রণের সময় রাজনীতি ও ব্যক্তিকে প্রাধান্য দেয়। যেখানে অর্থ জড়িত, সেখানে অপরাধ এখন বেশি। আর এই অর্থে নিয়ন্ত্রিত হয় কিছু পুলিশ সদস্য।
পুলিশের সাবেক এক ডিওজি বলেন, “সবচেয়ে বড় সমস্যা পুলিশের দক্ষতার চেয়ে এখন মনিটরিংয়ের অভাব। এখানে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অধীনস্থরা কী করে তার খোঁজখবর রাখেন না। এসপি সাহেবদের এখন বাইরে যেতে লজ্জা হওয়া উচিত। হাইওয়েতে ডাকাতি ঘটে, পুলিশ ডিউটিতে থাকে না।এখন পুলিশের সাথে অর্থের সম্পর্ক তাই সব শেষ।
তিনি বলেন, ‘আমাদের লোকজনও থানায় যায় নানা রকম সহযোগিতা পেতে। প্রাক্তন পুলিশ অফিসার হওয়ায় আমরা তাকে থানায়ও পাঠাই। কিন্তু অভিজ্ঞতা খুবই খারাপ। ডিবি (গোয়েন্দা বিভাগ) তো এখন পুরাই দোকান হয়ে গেছে।
তার কথায়, পুলিশকে নিয়ে মানুষ ভালো কথা বলে না। আমরা নিজেরাই বিব্রত।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের একজন নির্বাহী পরিচালক মানবাধিকার কর্মী বলেন, পুলিশ বাহিনীতে আর প্রকৃত পুলিশ নেই। তারা এখন অন্য কাজে ব্যস্ত। ফলে অপরাধ কমছে না।
তার মতে, সমাজে রাজনৈতিকসহ নানা ধরনের অস্থিতিশীলতা বাড়ছে। ফলে অপরাধ বাড়ছে। আর বিচার না হওয়ায় অপরাধীরা উৎসাহিত হচ্ছে।