সীমান্ত উত্তপ্ত: বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে মিয়ানমারের ২৬৪ বিজিপি সেনা
রাখাইনে সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও বর্ডার গার্ড ফোর্স (বিজিপি) তুমুল যুদ্ধ চলছে। লাগাতার গোলাবর্ষণে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটছে। দুই পক্ষের মধ্যে চলমান সংঘর্ষে উত্তপ্ত বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকাও। গতকালও মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেল বাংলাদেশে এসেছে। সীমান্ত এলাকার মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এমন পরিস্থিতিতে নাগরিকদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বান্দরবান জেলা বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) জনসংযোগ কর্মকর্তা (পিআরও) শরিফুল ইসলাম।
মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চলমান সংঘাতের কারণে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তুমব্রু সীমান্ত দিয়ে ২৬৪ বিজিপি সদস্য অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এছাড়া অভিযানের সময় সশস্ত্র গ্রুপের ২৩ সদস্যকেও আটক করা হয়েছে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী বলেন, সীমান্ত এলাকা বিজিবির নিয়ন্ত্রণে। যারা অনুপ্রবেশ করেছে তাদের পুশব্যাক করার চেষ্টা চলছে।
তিনি বলেন নতুন কোনো রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়া হবে না। অন্যদিকে, মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেল ও গুলি বাংলাদেশে পড়ে দুইজন নিহত হওয়ার ঘটনায় ঢাকায় নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয় ভারত সফরে মিয়ানমারের চলমান সংঘাত ও সীমান্ত সমস্যা নিয়ে আলোচনা হবে। আলোচনার মাধ্যমে যেকোনো সমস্যা সমাধানে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ।
বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (এএ) রাখাইনের মরাউক ইউ এবং কিয়াকতাও শহরে জান্তা বাহিনীর আরও দুটি ব্যাটালিয়নের সদর দফতর দখল করার দাবি করেছে। দলটি জানিয়েছে, সেনা সদর দফতর দখলের অভিযানের সময় ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। এতে মায়ানমার জান্তার অনেক সৈন্য নিহত হয়। আরাকান আর্মির এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর তিনটি ব্যাটালিয়ন ঐতিহাসিক রাজধানী ম্রাউক ইউ, ম্রাউক ইউ প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর, শহরের আবাসিক এলাকা এবং আশপাশের গ্রামগুলিতে গোলাবর্ষণ করেছে। রাথেডং, পোন্নাগিউন, রামরি এবং আন শহরে জান্তাদের বিমান ও সমুদ্রের বোমাবর্ষণের মধ্যে সংঘর্ষ অব্যাহত রয়েছে। আরাকান আর্মি মংডু শহরের বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে টাং পিয়ো সীমান্ত চৌকিতে হামলা চালায়।
এদিকে সীমান্তের ওপারে চলমান সংঘর্ষে সীমান্ত এলাকার মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের জলপাইতলী, বাজার পাড়া এলাকার মানুষ ভয়ে ঘর থেকে বের হচ্ছে না। তুমব্রু বাজার, বেতবুনিয়া বাজারের স্কুল-মাদ্রাসাগুলো ফাঁকা পড়ে আছে। গত সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত লাগাতার গোলাগুলির শব্দে নাইক্ষ্যংছড়ি ও ঘুমধুম এলাকার বাসিন্দারা আতঙ্কে রাত কাটায়। এতে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকার অন্তত ৮টি গ্রাম কেঁপে ওঠে। দোকানপাট বন্ধ থাকায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে পারছেন না স্থানীয়রা। সরজমিন দেখেছে, গ্রামে কয়েকজন পুরুষ ছাড়া কেউ নেইগ্রামে ।
নারী ও শিশুরা গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র বসতি স্থাপন করেছে। সবার মধ্যে বুলেটের ভয় কাজ করছে। স্থানীয়রা জানান, মায়ানমারের ঢেঙ্কোবুনিয়া সীমান্ত চৌকি দখলকে কেন্দ্র করে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (এএ) ও মিয়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) মধ্যে ব্যাপক গোলাগুলি ও মর্টার শেল ছোড়া হচ্ছে। ফলে সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে আতঙ্ক বেড়েছে।গ্রামের এক বাসিন্দা বলেন, মানুষ এখন যতটা ভয় পায়, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ও এতটা ভয় পায়নি।
এদিকে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বিভিন্ন পয়েন্টে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে গোলাবারুদের অব্যাহত ফায়ারিংয়ের কারণে ঝুঁকিতে থাকা লোকজনকে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রশাসন। মঙ্গলবার বিকেলে ঘুমধুম-তুমব্রু পরিদর্শন শেষে বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মুজাহিদ উদ্দিন এ নির্দেশ দেন। এদিকে প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে চরম ঝুঁকিতে থাকা সীমান্তের অর্ধহাজার পরিবারকে সরিয়ে নিতে প্রশাসন প্রাথমিকভাবে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নির্দেশ দেয়। গতকাল বিকেলে প্রশাসনের কর্মকর্তারা গণমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, সীমান্ত এলাকায় ঝুঁকিতে থাকা বাংলাদেশি নাগরিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বিবেচনা করা হয়েছে। এ ব্যাপারে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, বিজিবি ও পুলিশসহ সীমান্ত কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় জরুরি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ জানান, সীমান্তের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে লোকজনকে সরিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবনে আশ্রয় দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে।
সীমান্তে চলমান সংঘর্ষের প্রভাব পড়েছে কক্সবাজারের টেকনাফেও। এখানে দুদিক থেকে গুলি ও মর্টার শেল উড়ছে। এ নিয়ে এলাকার মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এদিকে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) জানিয়েছে, চলমান সংঘাতে এ পর্যন্ত দেশের ২৬৪ সেনা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। যেখানে মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড ফোর্স (বিজিবি), মিয়ানমার সেনাবাহিনী, ইমিগ্রেশন অফিসার, পুলিশসহ অন্যান্য সংস্থার সদস্যরা রয়েছেন। যেখানে বিজিপির কমান্ডারও রয়েছেন।
এ ছাড়া বিদ্রোহী সশস্ত্র গ্রুপের ২৩ সদস্যকেও আটক করেছে স্থানীয়রা। কক্সবাজারের উখিয়া সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশের সময় তাদের আটক করা হয়। পরে তাদের পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। সংঘর্ষের কারণে তারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে আসছেন। স্থানীয়রা তাদের দেখে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারা বোমা নিক্ষেপ করে। আহত হয়েছেন স্থানীয় কয়েকজন। পরে স্থানীয়রা তাদের ধাওয়া করে আটক করে। তাদের পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।