মাতৃগর্ভে থাকা অনাগত শিশুর লিঙ্গ প্রকাশ করা যাবে নাঃ হাইকোর্টের রুল
মাতৃগর্ভে থাকা শিশুর লিঙ্গ পরিচয় প্রকাশ করা যাবে না জানিয়ে হাইকোর্টে প্রতিবেদন দাখিল করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও চিকিৎসকসহ সবাইকে এ নীতি অনুসরণ করতে বলা হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, গর্ভজাত শিশুর লিঙ্গ পরিচয় প্রকাশ করা যাবে না মর্মে নীতিমালা ছয় মাস আগে জমা দেওয়া হয়েছিল। প্রতিবেদন দাখিল করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা বিভাগের পরিচালক ডা. তাহমিনা সুলতানা।
অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান স্বাস্থ্য সচিব, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং সমাজকল্যাণ সচিবকে এই নোটিশ পাঠান। নোটিশে সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক ও ক্লিনিক কর্তৃপক্ষকে অনাগত শিশুর লিঙ্গ পরিচয় নিশ্চিত করার লক্ষ্যে লিঙ্গ-পরিচয় পরীক্ষা প্রকাশ বন্ধ করতে তিন দিনের মধ্যে নির্দেশনা জারি করতে বলা হয়েছে।
আইনজীবী ইশরাত হাসান বলেন, আমাদের দেশে এখনো অধিকাংশ মানুষ ছেলের আশায় থাকে। কারণ তারা মনে করে ছেলেরা বংশ বহন করে, তারা উপার্জন করে, আরও শক্তিশালী। এমনকি অনেক মহিলাই মনে করেন যে একটি ছেলে হলে তাদের ভবিষ্যত রক্ষা হবে। এ অবস্থায় পরীক্ষার মাধ্যমে গর্ভে থাকা শিশুর লিঙ্গ পরিচয় জানা গেলে এবং তা অভিভাবকদের কাঙ্ক্ষিত না হলে তা গর্ভবতী মায়ের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার ওপর প্রভাব ফেলে। মা যদি বিষণ্ণতায় ভোগেন, তাহলে শিশুর মস্তিষ্ক সঠিকভাবে গঠন/বিকাশ করে না। চীন ও ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনাগত শিশুর লিঙ্গ পরিচয় প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তাই বাংলাদেশে নারী ও শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে গর্ভে থাকা শিশুদের লিঙ্গ পরিচয় প্রকাশ বন্ধ করা জরুরি।
তিনি বলেন, গর্ভবতী মা ও শিশুর কল্যাণে বা অনাগত শিশুর স্বাস্থ্য জানতে তারা যেকোনো পরীক্ষা করতে পারেন। কিন্তু শুধুমাত্র গর্ভে থাকা শিশুটি ছেলে না মেয়ে তা জানার উদ্দেশ্যে ডাক্তারি পরীক্ষা বা রিপোর্টে লিঙ্গ পরিচয় প্রকাশ করা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
অনাগত শিশুর লিঙ্গ পরিচয় প্রকাশ পূর্বে আইন দ্বারা নিষিদ্ধ ছিল। তবে সোমবার থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তাদের নতুন নীতিমালায় এটি অন্তর্ভুক্ত করেছে।
এর আগে, ২০২০ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি, মাতৃগর্ভে শিশুর লিঙ্গ পরিচয় প্রকাশ কেন অবৈধ নয় তা জানতে চেয়ে একটি রুল জারি করেছিল হাইকোর্ট। একই বছরের ২৬ জানুয়ারি হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করা হয়।
২০২০ সালে, স্বাস্থ্য বিভাগ হাইকোর্টে একজন আইনজীবীর দায়ের করা একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে নির্দেশিকা তৈরি করেছে, হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার সহ সংশ্লিষ্ট সকলের জন্য নির্দেশিকা অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক হবে যারা অন্যথা করবে তাদের শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। ‘পেশাদার নৈতিকতা’ লঙ্ঘন নির্দেশিকায় অনাগত শিশুর পরিচয় প্রকাশ না করাকে পেশাগত নৈতিকতা বলে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল যে পেশাগত নৈতিকতা উল্লেখ করেছে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অনাগত শিশুর লিঙ্গ পরিচয় চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যগত কারণ ছাড়া অন্য কোনো সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা অ-চিকিৎসাগত কারণে প্রকাশ করা যাবে না।
আদালতে জমা দেওয়া নির্দেশিকায় বলা হয়েছে
- কোন ব্যক্তি, হাসপাতাল, উর্বরতা কেন্দ্র, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ল্যাবরেটরি কোন লেখা বা চিহ্ন দ্বারা বা অন্য কোন উপায়ে অনাগত শিশুর লিঙ্গ প্রকাশ করবে না।
- এই বিষয়ে কোন বিজ্ঞাপন করা যাবে না।
- সরকারী মন্ত্রনালয়গুলি ডাক্তার, নার্স, পরিবার পরিকল্পনা কর্মী এবং প্রযুক্তিবিদদের অনাগত শিশুর লিঙ্গ পরিচয় প্রকাশের নেতিবাচক পরিণতি এবং নৈতিকতা এবং পেশাগত আচরণ সম্পর্কে প্রশিক্ষণ প্রদান করবে।
- হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার সহ মেডিকেল সেন্টারগুলি এই সম্পর্কিত সমস্ত ধরণের পরীক্ষার ডেটা রাখবে।
- হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার সহ মেডিকেল সেন্টারগুলো ডিজিটাল ও প্রিন্ট মিডিয়ার মাধ্যমে লিঙ্গ সমতা এবং কন্যা শিশুর গুরুত্ব তুলে ধরে বিভিন্ন বার্তা প্রচার করবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, “আমরা আমাদের নির্দেশিকা হাইকোর্টে জমা দিয়েছি। আদালত এক সপ্তাহের মধ্যে আমাদের ডেকে পাঠাবে। আদালত যদি এই নির্দেশিকাগুলো অনুমোদন করে তাহলে আমরা বাস্তবায়ন করব।”তারপর বিস্তারিত জানাব।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তার নির্দেশিকাতে বলেছে, “বাংলাদেশে ছেলেদের বেশি পছন্দের কারণে গর্ভে লিঙ্গ চিহ্নিত করা হলে লিঙ্গ বৈষম্য স্পষ্ট হয়। এর ফলে নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধি পায়। গর্ভবতী মা ও কন্যা শিশুরা অবহেলা আর অসম্মানের শিকার হয়।”
“বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ, ভারতসহ অন্যান্য অনেক দেশে অনাগত শিশুদের লিঙ্গ নির্ধারণ নিষিদ্ধ। এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের সংবিধান ও মানবাধিকারের পরিপন্থী।”