শীত আর পিঠা: বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অন্যতম সৌন্দর্য
পিঠা বাংলাদেশে আনন্দ ও উদযাপনের প্রতীক, যা শীতের সকাল ও সন্ধ্যাকে উপভোগ্য করে তোলে। শীতকাল আমাদের দেশে বিয়ের মরসুম । এবং পিঠা হল এই বিবাহ উদযাপনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। শহরের বিভিন্ন স্থানে পিঠা উৎসব বা পিঠা মেলার আয়োজন করা হয় যেখানে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষ পিঠা দেখতে ও খেতে আসে।
পিঠা আমাদের জন্য শুধু একটি খাবার নয়। এটি রন্ধনশিল্প, ঐতিহ্য এবং আনন্দের সংমিশ্রণ। পিঠা বাংলার ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি অংশ। শীত ও পিঠা একে অপরের পরিপূরক।
এ সময় কৃষকরা ঘরে ঘরে নতুন ধান তোলেন। এরপর নতুন ধান দিয়ে পিঠাপুলি বানানোর ধুম পড়ে যায়। মা, খালা, খালা, বোন, বোনেরা পিঠা বানায়। চারিদিকে শুরু হয় পিঠা উৎসব। তাজা নারকেল-আর গুড়ের সাথে গরম ভাপা পিঠা খাওয়ার মজাই আলাদা।
বাংলাদেশে প্রতি বছর বিভিন্ন উৎসবে পিঠাপুলির আয়োজন করা হলেও পিঠা খাওয়ার মৌসুম শুধু শীতকালে। নতুন চাল, খেজুরের রসের নতুন গুড়ে টইটম্বুর পিঠা বাঙালির শীতের উৎসবে আনন্দকে বর্ণিল করে তোলে।
প্রতিটি দেশের একটি ঐতিহ্যবাহী ডেজার্ট রয়েছে যা তাদের খাদ্য এবং সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটা নিঃসন্দেহে পিঠা। আমাদের কাছে পিঠা শুধু খাবারই নয়, স্মৃতি ,সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ভান্ডারও বটে।
ছোটবেলায় শীত মানেই মায়ের হাতের নানা স্বাদের ও ডিজাইনের পায়েস আর সেই পিঠার পেছনের ইতিহাসের গল্প শোনা। বা গরম গরম চিতই পিঠার সাথে মাংসের ঝোল বা তাজা তাজা ভর্তার একটি মুখরোচক নাস্তা।
এখন, শীতকালে, ঠেলাগাড়ি এবং ভ্যানগুলি শহর জুড়ে চিতই পিঠা বিক্রি করে, সাথে বিভিন্ন ধরণের সুস্বাদু খাবার। চিংড়ি, সরিষা, ধনেপাতা সহ অনেক স্বাদের ভর্তার ফিলিংসতো রয়েছেই। আর যাদের মিষ্টির প্রতি আকর্ষণ আছে তাদের জন্য রয়েছে ভাপানো গরম গুড়, মালাই এবং নারকেল জড়ানো ভাপা পিঠা।
আমরা যখন রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে পিঠা খাই বা বাড়ি ফেরার পথে পরিবারের জন্য পিঠা কিনি তখন আমাদের মধ্যে এক ধরনের আনন্দ কাজ করে।
তবে এগুলো ছাড়াও সারাদেশে বিভিন্ন ধরনের পিঠা পাওয়া যায়:
চিতই পিঠা
প্রতি বছর শীত আসলে আমাদের রান্নাঘরে মাটির পাত্র দেখতে পাওয়া যায় এবং সেই পাত্রগুলো শুধুমাত্র চিতই পিঠা তৈরির জন্যই ব্যবহার করা হয়। চিতই পিঠা ভর্তা, পুর বা দুধে ভিজিয়ে খাওয়া হয়। দুধ-গুড় দিয়ে একটু দুধে ভিজিয়ে উপরে নারকেল দিয়ে খাওয়া হয় ম্ন ভোলানো চিতই পিঠা।
পাটিসাপটা পিঠা
পিঠার কথা এলে পাটিসাপটা পিঠার কথা বলতেই হবে। পাটিসাপটা পিঠা কনডেন্সড মিল্ক পেস্ট বা নারকেল দিয়ে তৈরি করা হয় চালের গুড়া এবং খেজুরের গুড়ের নরম আবরণে। পাটিসাপটা পিঠা অঞ্চলভেদে ভিন্নভাবে পরিবেশন করা হয়, তবে সবগুলোই অনন্য ও সুস্বাদু।
ভাপা পিঠা
ভাপা পিঠা বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় পিঠা। এই রাইস কেক বা পনসটি চালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি করা হয়,ভেতরে থাকে গুড় ও নারকেলের সেই স্বাদের পুর। বাড়িতে, দোকানে ও রাস্তার পাশের স্টলে ভাপা পিঠা রান্নার ধরণে ভিন্নতা থাকলেও পিঠার স্বাদ একই থাকে। খুব কম মানুষই আছেন এই জনপ্রিয় শীতকালীন মিষ্টি পিঠা উপভোগ করতে ভুলে যান।
নকশি পিঠা
নকশি পিঠা বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অনাবিল নিদর্শন। এই শিল্প আমাদের খাদ্যের মধ্যেও তার পথ খুঁজে পেয়েছে। সেখান থেকে নকশি পিঠা। এই পিঠাগুলি চালের গুড়া দিয়ে খামির তৈরি করা হয় এবং খেজুরের গুড়ের মিশ্রণে ভিজিয়ে রাখার আগে সৃজনশীলভাবে নকশা কাটা হয়।
পুলি পিঠা
পুলি পিঠাও বিভিন্নভাবে তৈরি করে খাওয়া যায়। তবে ঐতিহ্যবাহী পুলি পিঠা তৈরি হয় গুড় ও নারকেল দিয়ে। দুধের পুলিতে দুধ ও মশলা ভেজানো হয় এবং খেজুর গুড় ও নারকেলের চিড় স্বাদের জন্য ব্যবহার করা হয়। গুড় ও নারকেল ভরা পুলি পিঠা তেলে ভাজা হয়।
বিশেষ করে ভাপা, চিতই এবং রস পিঠা শীতের সবচেয়ে জনপ্রিয় পিঠা। শীতকালে ভাপা ও চিতই পিঠা সর্বত্রই পাওয়া যায়, তবে গ্রামে গ্রামে রাস পিঠা বেশি পাওয়া যায়। দুধ ও নারকেলের সঙ্গে খেজুরের রস মিশিয়ে রস পিঠার স্বাদ সরাসরি মুখে না নিলে কোনোভাবেই বর্ণনা করা যাবে না।
বর্তমানে শহরাঞ্চলেও পিঠার জনপ্রিয়তা বাড়ছে। প্রতি বছর শীত মৌসুমে প্রায় সব শহরেই পিঠা উৎসবের আয়োজন করা হয়। তবে এ প্রভাব এখন রাজধানী ঢাকায় বেশি। শহরে বসে সেই গ্রামের বাঙালি শীতের স্বাদ না পেলেও, চুলার পাশে বসে আমাদের মায়েরা বানানো পিঠার কথা মনে পড়ে। এই পিঠা উত্সবগুলি আমাদের শহুরে জীবনে শীতল হওয়ার জন্য গ্রামে ফিরে যাওয়ার জন্য আকুল হয়ে উঠতে পারে।
এ উৎসব ছাড়াও পিঠার চাহিদা মেটাতে আমাদের শহরের অলিগলিতে রয়েছে ছোট ছোট পিঠার দোকান। তারা এখন সব শ্রেণীর মানুষের মধ্যে সমান জনপ্রিয়। দোকানগুলোতে শীতের বিভিন্ন ধরনের পিঠা রয়েছে, যেখানে চিতই এবং ভাপা বেশি দেখা যায়। আরও মজা হলো চিতই পিঠা দিয়ে নানা ধরনের খাবারের আয়োজন। বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষও ভিড় করছেন দোকানপাট ঘিরে। আর এভাবেই শীতের পিঠা উপভোগ করেন নগরবাসীও।