অনলাইনে প্রেমের ফাঁদঃ তিন পুলিশ কর্মকর্তার জড়িত থাকার অভিযোগ
প্রবাসী, ব্যবসায়ী বা ধনী ব্যক্তিদের টার্গেট । খোঁজখবর নিয়ে মোবাইল, ইমু, মেসেঞ্জারে প্রেমের জাল বিছানো হয়। এর পরে, তাকে কাছে টেনে নিশ্চিহ্ন করা হয়ে। করা হয় অপহরণ, নেয়া হয় মুক্তিপণ। তবে এ নিয়ে কথা বলতে নারাজ এ ভাইরাসে আক্রান্তরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ভাইরাল ভুক্তভোগী বলেন, আমি প্রতারিত হয়েছি।
শুরুতে হোয়াটসঅ্যাপ, আইএমও বা মেসেঞ্জারে সুন্দরী নারীদের ছবি পাঠানো হয়। তারপর প্রেমের অভিনয়। কথোপকথন চলে কয়েকদিন। একপর্যায়ে তাকে বাড়িতে ডেকে নগ্ন ছবি তুলে ব্ল্যাকমেইল করা হয়।
ফেনী শহরে ‘প্রেমের ফাঁদ’ সৃষ্টিকারী প্রতারক চক্রের সন্ধান পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে প্রতারণার শিকার হলেও জনসম্মানের ভয়ে অনেকেই মুখ খুলতে চান না। এমন একটি মামলার তদন্ত করতে গিয়ে প্রতারকদের সহযোগী হিসেবে তিন পুলিশ কর্মকর্তার নাম ও পরিচয় বেরিয়ে এসেছে। এ ঘটনায় সংশ্লিষ্টদের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র তিন পুলিশ কর্মকর্তার পরিচয় নিশ্চিত করেছে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ফেনী শহরে সংগঠিত রয়েছে একাধিক প্রতারক চক্র। এই চক্রের সদস্যরা মোবাইল ফোনে সুন্দরী নারীদের ছবি পাঠিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তিকে প্রলুব্ধ করত। তারপর প্রেমের ভান করে নম্বর বাড়িতে নিয়ে যায়। বাকি সদস্যরা অশ্লীল ছবি তুলে টাকা আদায়ের জন্য জিম্মি করে। নগরীর নাজির রোড, পাগলা মিয়া রোড, পাঠানবাড়ী রোড ও পুরাতন পুলিশ কোয়ার্টার এলাকায় এমন কয়েকটি বাড়ি থাকলেও কয়েকদিন পর পর বাসা বদল করে চক্রের সদস্যরা।
চক্রের সদস্যদের মধ্যে ফেনী সদরের ফাজিলপুর-ছনুয়া এলাকার আবুল কাসেম জুয়েল, সুন্দরপুর এলাকার জেবু প্রকাশ রূপা, দাগনভূনের ইয়াকুবপুর ইউনিয়নের দুধমুখা এলাকার শিমুল দাস, রাজু, জনি, আয়ু, বিবি রহিমা, দীপা, জুয়েলের স্ত্রী। রিমা আক্তার, সাথী, তার ভাই রুবেল ও শিল্পী আখতারের নাম উল্লেখযোগ্য। তাদের সহযোগী হিসেবে পুলিশের তিন উপ-পরিদর্শকের নামও উঠে এসেছে।
প্রতারকদের তথ্য অনুযায়ী পুলিশ অভিযানে গেলেও বাড়িতে ঢুকেনি। বাইরে থেকেই কৌশলে টাকা চুরি করতেন পুলিশজনেরা ।
সম্প্রতি এ সংক্রান্ত একটি মামলায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন দিদার হোসেন সুমন নামের এক ব্যবসায়ী। মডেল থানার বিপরীতে ব্লু সুপার কার্ট জেন্টস পার্লার ও বড়বাজারে আপন স্বর্ণ জুয়েলার্সের মালিক তিনি। তার বাড়ি শহরতলীর পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের মাটিয়ারা এলাকায়।
মামলার সূত্রে জানা যায়, পাঠানবাড়ী রোডের একটি ভবনের তৃতীয় তলার বাসায় বিবি রহিমা নামে এক নারী এক ব্যক্তিকে ডেকে নেন। সেখানে জুয়েল ও শিমুল দুজনের নগ্ন ভিডিও রেকর্ড করেন। এরপর কোনো উপায় না পেয়ে ওই ব্যক্তি বিকাশের কাছ থেকে ৬০ হাজার টাকা ও নগদ নম্বর দিয়ে মুক্ত হন। ওই টাকার মধ্যে রহিমা ও জেবুকে দেওয়া হয় ২০ হাজার টাকা এবং বাকি টাকা পুলিশের পকেটে যায়।
চট্টগ্রাম থেকে জহিরিয়া মসজিদের পাশের বাড়িতে এক ব্যক্তি আসছেন। সেখানে জেমি নামের এক নারীর সঙ্গে তার একটি নগ্ন ভিডিও রেকর্ড করা হয়। একপর্যায়ে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে ওই ব্যক্তিকে ছেড়ে দেওয়া হয়। সেখান থেকে এক পুলিশ কর্মকর্তা পেয়েছেন ২০ হাজার টাকা।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, জুয়েল একাধিক নারীর সঙ্গে চক্র নিয়ন্ত্রণ করতেন। একাডেমি রোডে অ্যাপোলো হাসপাতাল, স্টেডিয়াম সংলগ্ন ও পুরনো রেজিস্ট্রি অফিস সংলগ্নসহ চারটি বাসভবন রয়েছে তার। এরকম আরেকটি গ্যাংয়ের প্রধান চট্টগ্রামের জোরারগঞ্জ থানার জসিম উদ্দিনের ছেলে রাজু। তার চক্রে সাদিয়া, রাশি, মুন্নি, সালমা নামে বেশ কয়েকজন নারীর নাম জানা গেছে। তারা নগরীর রামপুর এলাকা ও কুমিল্লা বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন ‘তারা’ নিবাসের রাস্তায় ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে ফাঁদ ও প্রতারণা করতো। পুলিশ লাইনের কাছে তার বোনের বাসা থেকে রাজু নামে আরেক ব্যক্তি আরেকটি গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করে। এসব কার্যক্রমও রয়েছে। শিপু ও রুনাসহ এই চক্রের কয়েকজন সদস্য। গত ১৯ ডিসেম্বর দাগনভূয়ানা উপজেলার মাতুভুয়ানা ইউনিয়নের ৬০ বছর বয়সী এক যুবক সালাউদ্দিন মোড়ের কাছে উত্তরা আবাসিক এলাকায় রুনার বাড়িতে ভিডিওতে ধরা পড়েন। তার কাছে দুই লাখ টাকা দাবি করা হয়। ওই ব্যক্তি বললেন বাড়িতে গিয়ে টাকা দিতে।
ফেনী পৌরসভার ১৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আমির হোসেন বাহার সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “পুরাতন পুলিশ কোয়ার্টার বা রামপুর এলাকায় বাইরের লোকজন বাসা ভাড়া করে। তবে এ ধরনের অপকর্মের খবর পেলে আমরা ব্যবস্থা নিই।”
জানতে চাইলে পুলিশ সুপার জাকির হাসান বলেন, “এমন একটি গ্যাং আগে থেকেই পুলিশের নজরদারিতে রয়েছে। একজনকে আটক করার পর তার কাছ থেকে কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। তার দেওয়া তথ্যগুলো যাচাই করা হচ্ছে। পুলিশের কোনো সদস্য আছে কিনা। জড়িত রয়েছে তাও তদন্তাধীন।”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলে জানা যায়, একটি চক্র উপজেলার বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা ও সামাজিক ব্যক্তিদের টার্গেট করে প্রতারণা করছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রথম পরিচয়। সেই পরিচয় থেকেই ভিডিও কলে প্রেমের ভান করে অন্তরঙ্গ দৃশ্যের ভিডিও রেকর্ড করা হয়। চাহিদা মেটাতে না পেরে তাদের ভিডিও অনলাইনে প্রচার করা হচ্ছে।
কবিরাজ সেজে তার ব্যক্তিগত সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভিডিও করে তার মানহানি করছেন বলেও জানা গেছে। পরে গোপন ভিডিও ভাইরাল হওয়ার ভয় দেখিয়ে তাদের জিম্মি করে টাকা চাওয়া হয়। টাকা দিতে না পারলেই গোপন ভিডিও ভাইরাল করা হচ্ছে। ফলে জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতারা আতঙ্কে রয়েছেন।