November 22, 2024
ফ্লোর ক্রসিং

ফ্লোর ক্রসিং

ফ্লোর ক্রসিং

ফ্লোর ক্রসিং

ফ্লোর ক্রসিং (Floor crossing) অর্থাৎ ফ্লোরকে ক্রস করে কোথাও যাওয়া। এখানে ফ্লোর বলতে নিজ দলকে বোঝায়। ক্রসিং বলতে অন্য দলের সমর্থনকে বুঝায় ।

অর্থাৎ সংসদে ফ্লোর ক্রসিং মানে পাশ বদলানো। অর্থাৎ এক রাজনৈতিক দল ছেড়ে অন্য রাজনৈতিক দলে যোগদানকে ফ্লোর ক্রসিং বলে। সংসদীয় ভোটে নিজ দলের পক্ষে না থেকে অন্য দলের পক্ষ অবলম্বন করাকে বলা হয় ফ্লোর ক্রসিং

কোনো সংসদ সদস্য সংসদে তার দলের বিরুদ্ধে ভোট দিলে বা দল থেকে পদত্যাগ করলে সংসদে তার আসন শূন্য বলে গণ্য হবে। একে বলে ফ্লোর ক্রসিং।

তাই সহজ করে বলতে পারি; ফ্লোর ক্রসিং হলো নিজ দলের বিপক্ষে ভোটদান বা অন্য দলে যোগদান। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ফ্লোর ক্রসিং করলে সেই সংসদ সদস্যের পদ শূন্য হয়ে যায়।

ফ্লোর ক্রসিং শব্দটি মূলত ব্রিটিশ পার্লামেন্ট থেকে এসেছে; যেখানে ট্রেজারি এবং বিরোধী সদস্যরা ফ্লোরের  বিপরীত দিকে বসেন। ফ্লোর ক্রসিং এসেছে নিজের সংসদীয় দলের বিরোধী দলকে সমর্থন করা থেকে।

ফ্লোর ক্রসিং প্রধানত দুটি উপায়ে ঘটতে পারেঃ

(১) সরাসরি বিরোধী দলে যোগদান করে, বা

(২) সংসদে যেকোনো বিলে নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার মাধ্যমে।

একজন সংসদ সদস্য (বা কাউন্সিল) তার রাজনৈতিক দল ছেড়ে অন্য দলে যোগ দিতে বা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ফ্লোর অতিক্রম করতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, ব্রিটিশ হাউস অফ কমন্সের সদস্যরা ফ্লোরের বিপরীত দিকে বসে থাকা লোকদের (অন্য রাজনৈতিক দলের সদস্যদের) একটি দলে যোগ দিতে ফ্লোর অতিক্রম করে।

যেহেতু ক্রসিং শব্দটি একটি সুনির্দিষ্ট এবং নির্দিষ্ট প্রশ্নে হাউস বা সংসদে নিজের দলের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়াকে বোঝায়। সুতরাং, এই আইনটি মূলত জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সংসদ সদস্য, মন্ত্রীদের স্বাধীনতা হরণ করে। নিজের দলের কোনো সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করতে চাইলেও উপায় নেই। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া ইত্যাদি দেশে ফ্লোর ক্রসিং আইন পাওয়া যায়।

সম্ভবত সবচেয়ে বিখ্যাত ব্যক্তি যিনি ফ্লোর অতিক্রম করেছেন: উইনস্টন চার্চিল। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ফ্লোর ক্রসিং এখনও ঘটে কারণ এটি সদস্যদের তাদের নির্বাচনী আসন হারানোর ঝুঁকি থাকেনা। টনি ব্লেয়ারের শাসনামলে, তার লেবার পার্টির সাংসদরা তাদের নিজ দলের বিরুদ্ধে ভোট দিয়ে বিলটিকে আইনে পরিণত হতে বাধা দেন।

কেন এটি বাংলাদেশের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল:

পাকিস্তান আমলের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ একাধিক দলত্যাগের কারণে অস্থিতিশীলতার শিকার হয়েছে। ১৯৫৪ সালে, যুক্তফ্রন্ট সরকার এই দলত্যাগের কারণে কয়েকবার পতন ঘটে। এমনকি সংসদ সদস্যদের মারামারিতে ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলীর মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। সেই সময়ের সংসদ সদস্যদের ঘন ঘন দল পরিবর্তনের কারণে সরকার পতন বা সরকার পুনর্গঠনের অস্থিতিশীলতা থেকে মুক্তি পেতে মুজিব সরকারের পরামর্শে এই ৭০ টি অনুচ্ছেদ সংবিধানে সংযোজন করা হয়েছিল।

বাংলাদেশের ফ্লোর ক্রসিং আইনঃ

ফ্লোর ক্রসিং আইনটি বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে অন্তর্ভুক্ত ছিল। সংসদে ফ্লোর ক্রসিং ঠেকাতে এই আইন প্রণয়ন করা হয়। এটি ছিল দলত্যাগ বিরোধী বা ফ্লোর ক্রসিং বিরোধী আইন।

বাংলাদেশের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে ফ্লোর ক্রসিং এর উপর সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। যে সংসদ সদস্য ফ্লোর অতিক্রম করেন তিনি সংসদ সদস্যের পদে অধিষ্ঠিত  থাকতে পারবেন না। এতে করে সংসদ সদস্যরা নিজ  দলে  ভোট  দিতে বাধ্য হচ্ছেন। যদিও  সাংসদ  হিসেবে তাদের সুযোগ সীমিত হয়ে যাচ্ছে।

এই আইনটি মূলত সংসদীয় সরকারের প্রকৃতিতে হস্তক্ষেপ করে। সংসদীয় সরকারের মূল চেতনা হল সরকার আইনসভার কাছে দায়বদ্ধ। কিন্তু, দলত্যাগ বিরোধী বা ফ্লোর ক্রসিং বিরোধী আইনের অধীনে, সরকার এবং নির্বাহী শাখা এমন একটি অবস্থানে রয়েছে যেখান থেকে তারা স্বৈরাচারী শাসন চালাতে পারে বা এর সুযোগ পেয়ে যায়, কারণ সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বা ভোট দেওয়ার কেউ বাকি থাকেনা । সুতরাং, আইনসভায় সরকার কর্তৃক পাস করা অনৈতিক বিলের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ বা ভোট দেওয়ার কেউ থাকবে না।

১৯৭২ সালের সংবিধানে ফ্লোর-ক্রসিংয়ের বিরুদ্ধে দুটি প্রধান বিধান রয়েছে:

১. কোন সদস্য তার দল থেকে পদত্যাগ করলে। এবং

২. যদি তিনি ভোটের সময় তার দলের বিরুদ্ধে ভোট দেন।

কিন্তু সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীতে ফ্লোর ক্রসিংয়ের বিরুদ্ধে আইনকে শক্তিশালী করতে আরও দুটি বিধান যুক্ত করা হয়েছে। তা হল:

১. যদি কোন সদস্য সংসদে উপস্থিত থাকেন কিন্তু তারপরও ভোটদানে অংশ না নেন।

২. যদি কোন সদস্য ইচ্ছাকৃত সংসদে উপস্থিত না হন।

দ্বাদশ সংশোধনীতে আরও দুটি শর্ত যুক্ত করা হয়েছে।

১. কেউ একটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে একটি গ্রুপ গঠন করতে পারবেন না।

২. একজন নির্বাচিত সদস্য যদি অন্য কোন রাজনৈতিক দলে যোগ দেন তাহলে তা ৭০ অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন।

বিভিন্ন দেশের সংবিধানে এই বিধান:

১) যে কারণে একটি রাজনৈতিক দলের সদস্যকে ভারতের সংবিধানের অধীনে রাজ্যসভা বা লোকসভার সদস্য হিসাবে অবিরত থেকে অযোগ্য ঘোষণা করা হবে তার মধ্যে রয়েছে- (ক) দলের সদস্যপদ স্বেচ্ছায় পরিত্যাগ করা; বা (খ) দলের নির্দেশ উপেক্ষা করে ভোট দেওয়া বা দলের অনুমতি ছাড়া ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকা।

২) পাকিস্তানের একজন সংসদ সদস্য যদি নির্বাচনে তাকে মনোনীত করা দল থেকে পদত্যাগ করেন, বা প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনে বা আস্থার প্রস্তাবে অবাধ্য ভোট দেন বা ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকেন তাহলে তাকে পদে অধিষ্ঠিত হতে অযোগ্য ঘোষণা করা হবে।

আরও পড়ুন

বাংলাদেশের সরকার ব্যবস্থা

Leave a Reply

Your email address will not be published.

X