আড়াই গুণ বেড়ে বাংলাদেশে রেকর্ড বৈদেশিক ঋণ ১০০ বিলিয়ন ডলার
গত এক দশকে বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে অন্তত আড়াই গুণ। একদিকে যেমন বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বাড়ছে, তেমনি স্বল্প সুদে ঋণ পরিশোধের চাপও বাড়ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, অতিরিক্ত ঋণের দায় মেটাতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ থাকবে। যা টাকার মান আরও কমিয়ে দেবে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র দেশের বৃহত্তম একক বরাদ্দ প্রকল্প। বহুল আলোচিত এই প্রকল্পে ১ লাখ এক হাজার কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে রাশিয়া। অন্যদিকে বাংলাদেশে সরবরাহ করা হয় মাত্র ১৩ হাজার কোটি টাকা। রূপপুরের মতো দেশের অধিকাংশ মেগা প্রকল্প বৈদেশিক ঋণে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এসব প্রকল্পে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের পাশাপাশি বাড়ছে অর্থনীতি। তবে ঋণ পরিশোধের চ্যালেঞ্জও রয়েছে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণ ছিল ৪১ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার। এটি এখন দাঁড়িয়েছে৯৮.৯৪ বিলিয়ন ডলারে। অর্থাৎ এক দশকে বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে অন্তত আড়াই গুণ। এর মধ্যে ৮৮ বিলিয়ন ডলার সরকারি খাতে। বাকিটা বেসরকারি খাতে। অর্থাৎ গত এক দশকে ঋণ প্রবৃদ্ধির পরিমাণ প্রায় ৭০ শতাংশ। আর সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে।
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘এই মুহূর্তের বড় প্রকল্পগুলো ভবিষ্যতে সম্পদ যোগাবে। আমাদের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ যদি মানবতা, আধুনিকতা এবং কাজের পক্ষে হয়, তবে আমি ভয়ের কিছু দেখি না।’
তিনি আরও বলেন, ‘নতুন আরও ঋণ নেওয়া হবে। তা ৪০ বছর পর আসবে। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া. রিজার্ভ কিছুটা কমলেও আবার বাড়বে।
উন্নয়ন বিশ্লেষক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, ব্যবসা ও রাষ্ট্র সব জায়গায় নগদ অর্থের অভাব রয়েছে। এটি একটি বড় সংকটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ব্যয় ব্যবস্থার সংস্কার প্রয়োজন। মেগা প্রজেক্ট হোক বা নির্বাচনের সময়, তাকে দূরদর্শিতা দেখানো দরকার ছিল; এটা দেখেনি। এটি শক্তির অভাব এবং খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার হুমকির সম্মুখীন। সব মিলিয়ে সব দিক থেকে বিপদ আসছে।
দেশের চলমান ২০টি মেগা প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৭০ বিলিয়ন ডলার। যার মধ্যে বৈদেশিক ঋণই ৪৩ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, সরকারি-বেসরকারি বহুমুখী কার্যক্রম বাস্তবায়নে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ একশ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। এর মধ্যে সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠান নিয়েছে ৭৯ বিলিয়ন ডলার; বাকি ২১ বিলিয়ন ডলার নেবে বেসরকারি খাত। এই ঋণের প্রায় ৮৪ শতাংশ দীর্ঘমেয়াদী, এবং বাকি ১৬ শতাংশ স্বল্পমেয়াদী। গত সাত অর্থবছরে এই ঋণ দ্বিগুণ হয়েছে।
কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, চলমান বৈদেশিক মুদ্রা সংকটের মধ্যে সরকার ধাপে ধাপে এত ঋণ কীভাবে শোধ করবে? এমন পরিস্থিতিতে কড়া পরামর্শ দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা। ঋণ পরিশোধের জন্য আরও ঋণ গ্রহণের পরামর্শ।
বৈদেশিক ঋণের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে অর্থনীতিবিদ ড. মাহফুজ কবির বলেন, ২০২৪ সাল থেকে ঋণ শোধ না করলে আমরা প্রচণ্ড চাপে পড়ে যাব। আগামী বছর থেকে আমাদের যে বিপুল পরিমাণ ঋণ শোধ করতে হবে তা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অনেক চাপ সৃষ্টি করবে। তাই এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পরিস্থিতির উন্নতির জন্য আরও কিছু ঋণ প্রয়োজন। সুতরাং, এখন আমাদেরকে দ্বিপাক্ষিক ঋণ পরিহার করতে হবে, যার কঠোর শর্ত রয়েছে এবং ভাল উৎস থেকে ঋণ নিতে হবে।
আগামী বছর থেকে মেগা প্রকল্পসহ বিভিন্ন ঋণ পূরণে বাংলাদেশকে প্রতি বছর ৪ থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
তবে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে এ পরিমাণ ঋণকে বিপজ্জনক বলে মনে করেন না অর্থনীতিবিদ জামাল উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, আয় দিয়ে এ ঋণ পরিশোধ করতে হবে। আমাদের রপ্তানি ও রেমিটেন্স বাড়াতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে আমাদের পণ্যের রপ্তানি গন্তব্য বাড়াতে হবে। পোশাক খাত নিয়ে আমরা একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে বসে আছি। চামড়া শিল্পসহ অন্যান্য শিল্পের পণ্য রপ্তানি করে প্রতিযোগিতামূলক ব্যবসার পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত দাতা দেশ বা সংস্থাকে দেওয়া ঋণের ৩৩ শতাংশ বিশ্বব্যাংকের ছিল। তারপরে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) ২৪ শতাংশ এবং জাপানের ১৭ শতাংশ অবদান রয়েছে।
অপরিপক্ক অদক্ষ এবং দুর্নীতি মূলক বাংলাদেশ সরকার ও প্রশাসনকেও অর্থনৈতিক করুন অবস্থার জন্য দায়ী করেন অনেক অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ।
1 Comment