ফারাক্কা বাঁধঃ ইতিহাস চুক্তি ক্ষয়ক্ষতি
ফারাক্কা বাঁধ –Farakka Bridge
ফারাক্কা বাঁধ গঙ্গা বা পদ্মা নদীর উপর একটি বাঁধ। বাঁধটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলায় অবস্থিত। এই বাঁধের নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৯৬১ সালে। এটি ১৯৭৫সালে শেষ হয়। ১৯৭৫সালেই ২১ এপ্রিল থেকে বাঁধটি চালু হয়। ফারাক্কা বাঁধ ২২৪০ মিটার (৭৩৫০ ফুট) দৈর্ঘ্য।
এটি শুধু একটি বাঁধ নয়, এই অবকাঠামোটি সড়ক ও রেল যোগাযোগ সেতু হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। বাঁধটিতে মোট ১০৯ টি গেট রয়েছে। এই বাঁধ থেকে ফারাক্কা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে জল সরবরাহ করা হয়। ১৯৫০ এবং ১৯৬০ এর দশকে, হুগলি নদীর পলি ধুয়ে ফেলার জন্য কলকাতা বন্দরের কাছে ফারাক্কা বাঁধ তৈরি করা হয়েছিল। হিন্দুস্তান কনস্ট্রাকশন কোম্পানি তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তায় প্রায় এক বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে বাঁধটি নির্মাণ করে। ফারাক্কা বাঁধ, যেটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গের মধ্যে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম।
ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের ইতিহাস:
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা শুরু করে। ১৯৭৪ সালের ১৬ মে, বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ফারাক্কা পয়েন্টে গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা করেন। এই সম্মেলনে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে উভয় দেশ সমঝোতায় আসার আগে ভারত ফারাক্কা বাঁধ খুলবে না। যাইহোক, বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৫ সালে বাঁধের একটি অংশ পরীক্ষা করার জন্য ভারতকে মাত্র ১০ দিনের জন্য গঙ্গা থেকে ৩১০ থেকে ৪৫০ কিউসেক জল সরানোর অনুমতি দেয়। কিন্তু ভারত ১৯৭৬ সালের শুষ্ক মৌসুম পর্যন্ত গঙ্গা থেকে ১১৩০ কিউসেক পানি পশ্চিমবঙ্গের ভাগীরথী-হুগলি নদীতে সরিয়ে নিয়েছিল।
ফারাক্কা বাঁধ সংক্রান্ত চুক্তি:
- ভারত-বাংলাদেশ চুক্তি অনুযায়ী নদীতে ৭০ হাজার কিউসেক পানি থাকলে উভয় দেশ পাবে ৩৫ হাজার কিউসেক করে ।
- আর ৭৫ হাজার কিউসেক বেশি পানি থাকলে ভারত পাবে ৪০ হাজার কিউসেক, বাকিটা পাবে বাংলাদেশ।
- তবে কোনো কারণে ফারাক্কা নদীর পানি প্রবাহ ৫০ হাজার কিউসেক এর নিচে নেমে গেলে দুই দেশের পানির পরিমাণ কে পাবে তা পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেবে।
কিন্তু পদ্মা এলাকার জেলেদের নদী এলাকার মানুষের সাথে কথা বলে জানা যায় ভারতের সাথে পদ্মা অর্থাৎ গঙ্গা বা ফারাক্কা চুক্তির যে শর্ত ছিল তার তেমন কিছুই মানে নি ভারত সবগুলোই লংঘন করেছে।
তবে ভারতের খুশিমত বাঁধ থেকে অনিয়ন্ত্রিতভাবে অপসারণ ও পানি বন্ধের ফলে; বাংলাদেশ শুষ্ক মৌসুমে ভয়াবহ খরা এবং বর্ষা মৌসুমে প্রবল বন্যার শিকার হয়। ফারাক্কা বাঁধকে কেন্দ্র করে এই স্বেচ্ছাচারিতার ফলে শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতও মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের কারণে ভারতের ক্ষতি:
৪ দশক আগে যখন গঙ্গার উপর ফারাক্কা ব্যারেজ খুলে দেওয়া হয়েছিল, তখন এর প্রধান উদ্দেশ্যগুলির মধ্যে একটি ছিল জলপ্রবাহের একটি অংশ হুগলি নদীতে সরিয়ে দেওয়া এবং কলকাতা বন্দরকে পুনরুজ্জীবিত করা। কিন্তু বর্ষা মৌসুমে বিহার ও উত্তরপ্রদেশের একটি বড় অংশ প্লাবিত হচ্ছে। গঙ্গার তীরবর্তী মালদহ-মুর্শিদাবাদ জেলার দুর্ভোগ ও বিপর্যস্ত মানুষ দীর্ঘদিন ধরেই ফারাক্কা বাঁধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে আসছে। একইসঙ্গে ক্ষতিপূরণ, জমি ও পুনর্বাসনের দাবি জানিয়েছেন তারা। তারা অব্যাহত বন্যা ও নদীভাঙন রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়ে আসছেন। বলা যায়, ফারাক্কা বাঁধ পশ্চিমবঙ্গের জন্যও বড় মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফারাক্কা বাঁধের জেরে শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, প্রতিবেশী বিহারেও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সেখানে চলমান বন্যায় ১০ লাখের বেশি মানুষ ও দুই লাখ মানুষের ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিহার রাজ্য সরকার দাবি করে যে ফারাক্কা বাঁধের কারণে এই ক্ষতি হয়েছে এবং রাজ্যটি প্রায় প্রতি বছর বন্যা ও নদীগর্ভে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের কারণে বাংলাদেশের ক্ষতি:
শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার পানি নিষ্কাশন দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলাদেশের জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করে। এতে বাংলাদেশকে কৃষি, মৎস্য, বন, শিল্প, নৌপরিবহন, পানি সরবরাহ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।
ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের ফলে নদীর নাব্যতাঃ
ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের কারণে পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় নদীর নাব্যতা কমে গেছে। ফলে বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকা ঘন ঘন বন্যার সম্মুখীন হচ্ছে।
ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের কারণে মাটির লবণাক্ততাঃ
ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের ফলে বাংলাদেশের খুলনা অঞ্চলে মাটির লবণাক্ততা বেড়েছে। খুলনার রূপসা নদীর পানিতে ৫৬৩.৭৫ মিলিগ্রাম/লিটার ক্লোরাইড আয়নের উপস্থিতি পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। অধিকন্তু, শুষ্ক মৌসুমে লবণাক্ততা ভূগর্ভস্থ পানিতে প্রবেশ করছে কারণ স্বাদু পানির সরবরাহ কমে যাচ্ছে।
ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের কারণে কৃষিতে প্রভাবঃ
কৃষির অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। পানির স্তর নেমে যাওয়ায় সেচ প্রকল্পের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের ফলে মৎস্য চাষে প্রভাবঃ
জল অপসারণের ফলে পদ্মা ও এর শাখা-প্রশাখাগুলোর প্রবাহের ধরন, জলপ্রবাহের বেগ, মোট দ্রবীভূত পদার্থ (Total dissolved solids) এবং লবণাক্ততার পরিবর্তন ঘটেছে। এই বিষয় গুলো মাছের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গঙ্গার জলের উপর এই এলাকার প্রায় দুই শতেরও বেশি মাছের প্রজাতি ও ১৮ প্রজাতির চিংড়ী নির্ভর করে। ফারাক্কা বাঁধের জন্য মাছের সরবরাহ কমে যায় এবং কয়েক হাজার জেলে বেকার হয়ে পড়েন।
ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের কারণে জাহাজ চলাচলে প্রভাবঃ
শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশের ৩২০ কিলোমিটারের বেশি নৌপথ চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ে। ফলস্বরূপ, হাজার হাজার মানুষ বেকার হয়ে পড়ে, শিপিং খরচ বৃদ্ধি পায়।
2 Comments