গাছের কান্না কেউ শোনে না
গাছ মানুষের নানাভাবে উপকার করে। ফল, ফুল, কাঠ, অক্সিজেন, ছায়া সবকিছুই আমরা গাছ থেকে পাই। গাছপালার উপকারিতাকোনভাবেই অস্বীকার করা যাবে না।
যেমন আর্থিক সুবিধার কথা বলি। ইন্ডিয়ান ফরেস্ট ইনস্টিটিউটের গবেষকরা ৫০বছর বেঁচে থাকা একটি গাছের আর্থিক সুবিধা বের করেছেন। অর্থাৎ গাছ পরিবেশকে বায়ু দূষণ থেকে রক্ষা করে ১০ লাখ টাকা, জীবন রক্ষাকারী অক্সিজেন সরবরাহ করে ৫ লাখ টাকার , বৃষ্টির অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে ৫ লাখ টাকা সাশ্রয় করে, মাটির ক্ষয় রোধ করে উর্বরতা বাড়ায় এবং খাদ্য সরবরাহ করে ৫ লাখ টাকা সাশ্রয় করে। এবং গাছে বসবাসকারী প্রাণীদের আশ্রয় ৫ লাখ টাকা সাশ্রয়, ৫ লাখ টাকার আসবাবপত্র, জ্বালানি কাঠ ও ফলমূল যোগান, বিভিন্ন প্রাণীর খাদ্য সরবরাহ করে আরও ৪০ হাজার টাকা সাশ্রয়। এককথায় একটি গাছের আর্থিক সুবিধার মোট মূল্য দাঁড়ায় ৩৫ লাখ ৪০ হাজার টাকা। যেসব এলাকায় গাছ বেশি, সেখানে বন্যা ও ঝড় তেমন ক্ষতি করতে পারে না। গাছপালা মাতৃগর্ভের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে মানুষকে রক্ষা করে।
কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ পরিবেশবিদ মির্জা মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন বলেন, পেরেক দিয়ে গাছে তৈরি গর্ত দিয়ে পানিসহ বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া ও অণুজীব প্রবেশ করে। এতে দ্রুত গাছ পচে যায়। ফলে এর খাদ্য ও পানি শোষণ প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। এতে করে গাছ মরে যেতে পারে।
কুড়িগ্রামে বিজ্ঞাপন ও রাজনৈতিক প্রচারণায় ছেয়ে গেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মহাসড়কের পাশের গাছপালা। জেলার বিভিন্ন সড়কে গাছে লাগানো বিজ্ঞাপন বোর্ডে সয়লাব। শুধু গাছ নয়, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সীমানা প্রাচীরও বিজ্ঞাপন থেকে নিরাপদ নয়।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা সড়কে লাগানো ছোট-বড় গাছে লোহার পেরেক দিয়ে আটকে আছে অসংখ্য সাইন বোর্ড , ব্যানার, ফেস্টুন, বিলবোর্ড। বিভিন্ন গাছে ঝুলছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, চিকিৎসক ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অসংখ্য ছোট-বড় সাইনবোর্ড। পিছিয়ে নেই বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কোচিং সেন্টারগুলোও।পরিবেশের সৌন্দর্য নষ্ট করার পাশাপাশি পরিবেশের ভারসাম্যেও বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
কথায় আছে, গাছ মানুষের সেরা বন্ধু। গাছ মানুষকে অক্সিজেন দেয়। মানুষ ও প্রাণীরা সেই অক্সিজেন নিয়েই বেঁচে থাকে। কেউ কেউ জীবন রক্ষাকারী গাছের ক্ষতি করছে। গাছ শুধু আমাদের জীবন বাঁচায় না, বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকেও আমাদের ঘরবাড়ি রক্ষা করে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কুড়িগ্রাম বিজিবি-২২ ব্যাটালিয়ন ক্যাম্প ও আনসার ভিডিপি কার্যালয়ের সামনে চিলমারী-কুড়িগ্রাম সড়কের দুই পাশে সারিবদ্ধভাবে বড় বড় গাছ লাগানো রয়েছে। আর সেই আম, মেহগনি, অর্জুনসহ বিভিন্ন গাছে ছেয়ে গেছে অসংখ্য পোস্টার ও ফেস্টুন।
নাগেশ্বরী উপজেলা পরিষদ চত্বরে নারিকেল গাছসহ বিভিন্ন গাছে পেরেক ঠেকেছেন স্থানীয় সরকার, দলীয় রাজনৈতিক নেতারা।
রাজারহাট উপজেলার নাজিমখা সড়কের রাজারহাট পাইলট, বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও মীর ইসমাইল ডিগ্রি কলেজ ও সড়কের দুই পাশে রাজনৈতিক দলের শত শত পোস্টার, ফেস্টুন ও ব্যানারে ছেয়ে গেছে।
নাগেশ্বরী উপজেলার এক বাসিন্দা বলেন, “পুরো উপজেলার বিভিন্ন অফিস ও গাছে শুধু নেতাদের ছবি সম্বলিত পোস্টার সাঁটানো হয়েছে। এতে করে সরকারি অফিসের সৌন্দর্য নষ্ট হয়েছে। শুধু জুন মাস আসলে প্রতি বছর নামমাত্র রং-চং কিন্তু কয়েকদিন পর আবার একই ছবি।
রাজারহাট উপজেলার বাসিন্দা এক কলেজ ছাত্র বলেন, নাজিমখা সড়কের প্রায় এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে প্রায় পাঁচ শতাধিক গাছে পোস্টার-ফেস্টুন সাঁটানো হয়েছে। আইন থাকলেও তা শুধু কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ। অভিযান চালিয়ে জেল, জরিমানা দেখিনি কক্ষনোই।
কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ পরিবেশবিদ মির্জা মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন বলেন, পেরেক দিয়ে গাছে তৈরি গর্ত দিয়ে পানিসহ বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া ও অণুজীব প্রবেশ করে। এতে দ্রুত গাছ পচে যায়। ফলে এর খাদ্য ও পানি শোষণ প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। এতে গাছ মারা যেতে পারে।
সুতরাং একটি গাছে পেরেক মারার অর্থ সেই গাছের চরম ক্ষতি করা। গাছের পরিচর্যা না করে বিজ্ঞাপনের নামে গাছের ব্যাপক ক্ষতি করা হচ্ছে। তিনি বলেন, গাছের প্রতি এই নিষ্ঠুর আচরণ দেশের বন আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
কুড়িগ্রাম সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি আহসান হাবিব নীলু ও আইনজীবী আহসান হাবিব নীলু বলেন, নগরীর সৌন্দর্য ও পরিচ্ছন্নতা রক্ষার জন্য সরকার ২০১২ সালে দেয়াল লিখন ও পোস্টার স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০১২ পাস করে। স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া কেউ পোস্টার, ফেস্টুন, বিলবোর্ড লাগালে বিনাশ্রম জরিমানা ও কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু এ আইনের প্রয়োগ না হওয়ায় শুরু হয়েছে বিজ্ঞাপনের নামে সৌন্দর্য বিনষ্টের প্রতিযোগিতা। তিনি ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম নিয়মিত রাখার দাবি জানান।
তবে গতানুগতিক বিবৃতি দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক সাইদুল আরিফ। তিনি বলেন, জেলার মাসিক সমন্বয় সভায় গাছে পোস্টার, ফেস্টুন ইত্যাদি লাগানোর বিরুদ্ধে অভিযান শুরুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এগুলো অপসারণে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।