ব্যতিক্রমী দেনমোহরে বিবাহ
দেনমোহর ইসলামিক বিবাহের অন্যতম সৌন্দর্যের অংশ; যা বর কর্তৃক কনের বৈবাহিক সূত্রে প্রাপ্য অধিকার । কিন্তু এটা যদি প্রতিযোগিতামূলক সামাজিক মর্যাদার চিহ্ন হয়ে যায় তখনি বরের উপর বিশাল অংকের অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি হয় । নারীদের সামাজিক মর্যাদা ও সুরক্ষা বিধানের নিমিত্তে ইসলামের এই দেনমোহর আইনটি সংযোজিত হয়েছে । কিন্তু সমাজে কনেদের বিবাহের তুলনামূলক প্রতিযোগিতায় অনেক সময়ই দর কষাকষিতে বরদের উপরে বিশাল অংকের দেন মোহরের চাপিয়ে দেয়া হয় ।
তখনই ইসলামের সীমারেখাকে কঠিন ভাবে লংঘন করা হয় । এবং এটা মেয়েদের স্মার্টনেসের অংশ হয়ে দাঁড়ায় এবং বর তখন অনেকটা বাধ্য হয়ে ঋণ করে হলেও যেকোনো উপায়ে সম্মান ঠিক রাখতে এগিয়ে যায় । সেদিকে ব্যতিক্রম করেছে কুমিল্লার এই বিবাহ । ইসলামের এত বড় চমৎকার বিধানকে না ভালোবেসে, তাৎপর্য না বোঝে অসুস্থ প্রতিযোগিতার খোলসে বরদের প্রতি অনেকটাই অত্যাচার করা হয় । সে দিক থেকেই একটি ভিন্নধর্মী বিবাহের ঘটনার বর্ণনায় এই আলোচনা ।
কনে সুকৃতি আদিত্য বলেন, ‘আমি মনে করি অনেক বিয়েতে দেনমোহর নিয়ে যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে তা এড়ানো উচিত। কারণ বিয়েতে আর্থিক লেনদেন মুখ্য নয় কিন্তু দুই জনের মনের মিলটাই বড় কথা।
নাটোরের এক বধূ নগদ টাকা বা গহনার বদলে বিয়ের দেনমোহর হিসেবে পরিবেশবান্ধব গাছ বেছে নিয়ে নজির স্থাপন করলেন।
শুক্রবার নাটোর শহরের দিঘাপতিয়ায় ঐতিহাসিক উত্তরা গণভবনের পাশে ব্যতিক্রমী দেনমোহরের মধ্যে বিয়ে হয়।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বিয়ের হৈ-হুল্লোড়ের মাঝখানেই বর-কনে চারা রোপণ ও পরিচর্যা করছেন। এমন ব্যতিক্রমী ও পরিবেশবান্ধব বন্ধনের কারণে বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে।
নাটোরের বধূ সুকৃতি আদিত্য দেনমোহর হিসেবে কুমিল্লার বর নবীন আদনান অঙ্কনের কাছ থেকে ৫টি ফলজ ও বনজ গাছ নিয়েছেন।
সুকৃতি আদিত্য বলেন, “আমি মনে করি, অনেক বিয়েতে যৌতুক নিয়ে যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে, তা থেকে বেরিয়ে আসা উচিত। কারণ বিয়েতে আর্থিক লেনদেন মুখ্য নয়; বরং দুজনের মনের মিলই বড় কথা।
সেখান থেকে আমি অনুভব করেছি যে যদি এমন কিছু করা যায় যা আমাদের প্রকৃতিকে সুস্থ রাখবে এবং আমাদের সম্পর্ককেও সুস্থ রাখবে। তাই নতুন জীবন শুরু করার আগে ভেবেছিলাম, গাছ হতে পারে একটি বড় হাতিয়ার; যেটার মাধ্যমে পরিবেশটাও সুস্থ থাকলো, আমরাও খুশি থাকলাম পরিবেশের সুস্থতা দেখে।’
বর নবীন আদনান বলেন, ‘স্ট্যাম্পের বিষয় নিরাপত্তা। আমার কাছে মনে হয় আমাদের নিরাপত্তার চেয়ে পরিবেশের নিরাপত্তা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যৌতুক হিসেবে গাছের বিষয়টি মূলত প্রতীকী। এর বাইরে বিশেষ কিছু নেই। উদাহরণ হিসেবে, আমরা এই বিষয়ের অনুশীলন করেছি যাতে আমরা পরিবেশ, প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবনযাপন করতে পারি। আমি সুকৃতির ভিন্ন চিন্তাকে সালাম জানাই।’
কনে সুকৃতির বাবা-মায়ের গাছ এবং পরিবেশের প্রতি গভীর ভালবাসা রয়েছে। সেই ভালবাসা থেকেই তিনজনের পরিকল্পনা অনুযায়ী সুকৃতি তার বিয়ের যৌতুক হিসেবে গাছটিকে বেছে নেন বলে জানান কনের বাবা এম আসলাম লিটন।
তিনি বলেন, ‘আমার মেয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে বিয়েতে দেনমহর নেবে না। বাবা হিসেবে আমি তার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। সে সমাজে একটা বার্তা দিতে চান যে বিয়েতে দেনমহর এর পরিমাণ বা টাকার অংকটাই আসল নয়। আসল হচ্ছে দুটি মানুষের বন্ধন।
“বিয়ের মাধ্যমে দুজন মানুষের হৃদয় ও মন একত্রিত হয়। এই বন্ধনটিই বাস্তব। একটি আধ্যাত্মিক চুক্তি একটি আর্থিক বা বস্তুগত চুক্তির চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়টি ভালো লেগেছে। আমি একজন বাবা হিসেবে গর্বিত।’
এ ঘটনায় বর-কনে, আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীরা অবাক হলেও সবাই নবদম্পতির প্রশংসা করেছেন। জীবনে প্রথম এমন বিয়ে দেখে তারা অবাক।
স্থানীয় গুলজান বেগম বলেন, ‘এমন ব্যতিক্রমী বিয়ে জীবনে দেখিনি। বর-কনে বাড়িতে এসে গাছ লাগাতে দেখে ভালো লাগলো। নতুন দম্পতি সুখে থাকুক।’
সৈয়দ মাসুম রেজা নামে এক সংস্কৃতিকর্মী বলেন, ‘সব সময়ই দেখেছি বধূদের দেনমহরের টাকা বাড়াতে আর বাড়াতে । কিন্তু সুকৃতির বিয়েতে ব্যতিক্রম দেখলাম। তার চিন্তাশীলতা অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।
কনে সুকৃতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ প্রাচ্যকলা বিভাগ থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেছে এবং বর নবীন আদনান একই অনুষদের পেইন্টিং অ্যান্ড ইলাস্ট্রেশন বিভাগ থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেছে। নবীন এখন ঢাকায় শিল্প পরিচালক হিসেবে কর্মরত।
ছয় তারা পূর্ব পরিচয় থেকে ভালবাসার বন্ধনে জড়িয়ে পড়েন। পরে উভয় পরিবারের সম্মতিতে সুকৃতি-নবীনের বিয়ে হয়।
উল্লেখ্য, ইতিপূর্বেও বগুড়ার ধুনট উপজেলার বর নিখিল নওশাদ কনে শান্তনা খাতুনকে ১০১টি বই দেনমহর দিয়ে বিয়ে করেন। (১৬ সেপ্টেম্বর, ২২ ,শুক্রবার ) সন্ধ্যায় গোসাইবাড়ী কাজী অফিসে বিয়ে সম্পন্ন হয়।
1 Comment