যান চলাচলে বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির শহর ঢাকা
যানজটের কারণে বিশ্বের ধীরগতির শহরে পরিণত হয়েছে ঢাকা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে কাজের সময় ও জ্বালানি নষ্ট হচ্ছে এবং বায়ু দূষণও বাড়ছে।যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চের এক গবেষণায় ঢাকা সম্পর্কে এমন তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণা সূচকে ঢাকার স্কোর রয়েছে ০.৬০। এর পরেই ০.৫২ পয়েন্ট নিয়ে নাইজেরিয়ার লাগোস।ঢাকা মহানগরীর সড়কে চলাচলকারী প্রায় সব মানুষেরই নিয়মিত যানজটের একই অভিজ্ঞতা রয়েছে।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে কাজের সময় ও জ্বালানি নষ্ট হচ্ছে এবং বায়ু দূষণও বাড়ছে। আর্থিক ক্ষতি দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) কেও প্রভাবিত করে।বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ‘দ্য ফাস্ট, দ্য স্লো, অ্যান্ড দ্য কনজেস্টেড: আরবান ট্রান্সপোর্টেশন ইন রিচ অ্যান্ড পুওর কান্ট্রিজ’ শীর্ষক গবেষণাটি গত আগস্টে প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণায় বিশ্বের ১৫২টি দেশের ১২০০টি শহরের ওপর কাজ করা হয়েছে। গবেষণায় চীন ও উত্তর কোরিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা ছাড়াও বাংলাদেশের ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রাম বিশ্বের শীর্ষ ২০টি ধীরগতির শহরের তালিকায় রয়েছে। ময়মনসিংহের অবস্থান নবম, চট্টগ্রামের অবস্থান দ্বাদশ। বিপরীতভাবে, বিশ্বের শীর্ষ 20টি সবচেয়ে গতিশীল শহরের মধ্যে ১৯ টি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।
গরীব এবং ধনী দেশগুলির তুলনা করে, গবেষণায় দেখা গেছে যে ধনী দেশগুলির শহরগুলিতে গাড়ির গতি দরিদ্র দেশগুলির তুলনায় কমপক্ষে ৫০ শতাংশ বেশি। উচ্চ গতিসম্পন্ন একটি শহরের মাথাপিছু আয়ও বেশি।
গবেষণায় মন্থরতার সাথে যানজটের সম্পর্ক নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে। আল্টো ইউনিভার্সিটির এক গবেষক বলেন, একটি ঘনবসতিপূর্ণ শহর সবসময় ধীরগতির নাও হতে পারে; এবং সবচেয়ে কম ঘনবসতিপূর্ণ শহরটিও সবচেয়ে ধীর হতে পারে।
তথ্য-উপাত্তে এমন চিত্র উঠে এসেছে। কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোটা বিশ্বের ২০ টি ঘনবসতিপূর্ণ শহরের তালিকার শীর্ষে রয়েছে। তবে এ তালিকায় ঢাকার নাম নেই। ঘনবসতিপূর্ণ নয় এমন ধীর গতির শহরের তালিকায় ঢাকা দ্বিতীয়।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই) বাংলাদেশের সড়ক ব্যবস্থা, যানজট এবং ঢাকার পরিবহন পরিস্থিতি নিয়ে নিয়মিত গবেষণা করে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চের এই গবেষণার প্রেক্ষিতে এআরআই-এর সাবেক পরিচালক ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘গবেষণার ফলাফল নিয়ে আমরা চিন্তিত, এটা ভয়াবহ। এই গবেষণা খুবই যৌক্তিক। আমাদের যানবাহন প্রধান সড়ক থেকে শাখা সড়কের দিকে যাচ্ছে।
হাদিউজ্জামান বলেন, “আমরা আমাদের সড়ক কিছুতেই ম্যানেজ করতে পারিনি। এ কারণে আমাদের সড়কে কম যানজট থাকলেও বিশ্বের অন্যান্য শহরের তুলনায় আমাদের শহরের গতি কমে যায়। অবকাঠামো নির্মাণ করে যানজট কমানো আর সম্ভব নয়। এখন নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়।
২০২০ সালে পরিচালিত বুয়েটের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে পিক আওয়ারে রাস্তায় চলাচলকারী যানবাহনের গড় গতি ছিল ঘন্টায় সাড়ে ছয় কিলোমিটার। ২০২২ সালে, এই গতি প্রায় ৪.৮ কিলোমিটারে নেমে এসেছে। বিপরীতে, শারীরিকভাবে সুস্থ মানুষের গড় হাঁটার গতি ঘণ্টায় তার চেয়ে বেশি
বিশ্বখ্যাত গবেষণা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান প্লাস ওয়ান জার্নাল এক গবেষণায় বলছে, ২০ থেকে ২৯ বছর বয়সী মানুষের হাঁটার গতি ঘণ্টায় ৪ দশমিক ৯ কিলোমিটার। ৩০ থেকে ৫০ বছর বয়সী মানুষের হাঁটার গতি ঘণ্টায় ৫.১ কিমি। ৬০-বছর বয়সী মানুষের হাঁটার গতি প্রতি ঘন্টায় ৪.৮২ কিমি। আর সত্তরের বেশি মানুষ ঘণ্টায় ৪.৫ কিলোমিটার হাঁটতে পারে। এভাবে বিভিন্ন বয়সের মানুষের হাঁটার গড় গতি ঘণ্টায় ৪.৮৩ কিমি, যা পিক আওয়ারে ঢাকার রাস্তায় গাড়ির বর্তমান গতির চেয়ে বেশি।
ঢাকা মহানগরীর পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার দিকে তাকালে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় (আরএসটিপি) আশঙ্কা করা হয়েছিল, ২০৩০ সালের মধ্যে সড়কে যানবাহনের গতি মানুষের হাঁটার চেয়েও কমে যেতে পারে। পরিস্থিতি যে দিকে যাচ্ছে, ভবিষ্যতে ঢাকার সড়কের অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে।
নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে পরিকল্পনার কোনো ঘাটতি দেখছেন না। তিনি বলেন, আরএসটিপিতে হাঁটার জায়গা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। এর পাশাপাশি গণপরিবহনের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং সড়কের জমির সঠিক ব্যবহারকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মূল সমস্যা প্রাইভেট কার। সড়কের ৮০ শতাংশ জায়গা বিলাসবহুল গাড়ির দখলে চলে যাচ্ছে।
আরও পড়তে
বায়ুদূষণে শীর্ষে অপরিকল্পিত ঢাকাঃ পুরো জানুয়ারি মাসজুড়ে মেলেনি বিশুদ্ধ বাতাস
৭ মাত্রার উপরের ভূমিকম্প হলে ঢাকাসহ বাংলাদেশে ঘটে যেতে পারে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ধ্বংসলীলা
এদিকে রাজধানীতে একজন মানুষের দৈনিক গড়ে দুই ঘণ্টা ৪৬ মিনিট সময় নষ্ট হচ্ছে যানজটে। এভাবে বছর শেষে জনপ্রতি ২৭৬ ঘণ্টা নষ্ট হয়। ভারী যানবাহনের কারণে অতিরিক্ত জ্বালানিও পোড়াতে হচ্ছে।
সব মিলিয়ে উৎপাদনশীলতা নষ্ট হয়। বায়ু দূষণের কারণে মানবস্বাস্থ্যের ক্ষতির পাশাপাশি এর চিকিৎসায় বছরে চার হাজার টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করতে হয়।
1 Comment