নৃশংস পিলখানা ট্র্যাজেডির ১৪ বছর শেষঃ কি অবস্থা বিচারের?
শনিবার বিডিআর সদর দপ্তরে সেনা কর্মকর্তাদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ১৪তম বার্ষিকী। শোকাবহ পিলখানা ট্রাজেডি দিবস। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় সাবেক বিডিআর ও বর্তমান বিজিবি সদর দফতরে একটি মর্মান্তিক নৃশংস ঘটনা ঘটে। সেদিন সকাল ৯:২৭। একদল বিদ্রোহী বিডিআর সৈন্য দরবার হলের চলমান সভায় ঢুকে পড়ে। এক বিডিআর সদস্য মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের বুকে আগ্নেয়াস্ত্র তাক করে। এরপর ঘটে ইতিহাসের জঘন্যতম নির্মম ঘটনা। বিডিআরের বিদ্রোহী সৈন্যরা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে সেনা কর্মকর্তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করে এবং তাদের পরিবারকে জিম্মি করে। পুরো পিলখানাতে একটি ভয়ঙ্কর আতঙ্ক তৈরি করে। এ সময় তারা ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। বিজিবি সদর দপ্তর পিলখানায় সেদিন বিদ্রোহী বিডিআর সদস্যরা যে তাণ্ডব চালিয়েছিল, পৃথিবীর কোনো শক্তিধর বাহিনীতেও বিদ্রোহের ইতিহাসে তা খুঁজে পাওয়া যায় না।
হত্যার বিচার না পেয়ে ব্যথিত স্বজনরা: প্রতিবছর এই দিনটি স্মরণে বনানীতে সামরিক কবরস্থানে নিহতদের স্বজনরা শোকে মুহ্যমান হয়ে থাকে । তাদের একটাই আক্ষেপ, ‘আমরা আর কী চাই? আজও হত্যার বিচার পাইনি। আমরা চাই হত্যার বিচারটা অন্তত সুষ্ঠুভাবে হোক। মরার আগে যদি শুনতে পেতাম বিচার হয়েছে , তাতেও শান্তি পেতাম। আজও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়নি। রায় কার্যকর হলে অন্তত আত্মা শান্তি পাবে। স্বজনরা চান দ্রুত রায় কার্যকর হোক।
বিচারের বর্তমান অবস্থাঃ
হত্যা ও বিস্ফোরক আইনের দুই মামলা: পিলখানায় নারকীয় হত্যার ঘটনায় দায়ের করা হয় দুটি মামলা। এর মধ্যে সেনা কর্মকর্তাদের নিহতের ঘটনায় দণ্ডবিধি আইনে করা হয় হত্যা মামলা। অপরটি হয় বিস্ফোরক আইনে। বিস্ফোরক আইনে দায়ের করা মামলাটি ১৩ বছর ধরে সাক্ষ্য গ্রহণের মধ্যে আটকে আছে। হত্যা মামলায় নিম্ন আদালত ২০১৪ সালে ১৫২ বিডিআর জওয়ানকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয় ১৬১ জনকে। সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা পান আরও ২৫৬ জন। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় খালাস পান ২৭৮ জন। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন আসামিরা। ২০১৭ সালে হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ ১৫২ জনের মধ্যে ১৩৯ জওয়ানকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। যাবজ্জীবন দেয়া হয় ১৮৫ জনকে। বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয় আরও ২০০ জনকে। খালাস পান ৪৫ জন।
উচ্চ আদালতে শুনানির অপেক্ষায় মৃত্যুদণ্ডের আপিল : হত্যা মামলায় হাইকোর্টের রায়ে খালাস ও সাজা কম পাওয়া আসামিদের মৃত্যুদণ্ড চেয়ে লিভ টু আপিল দায়ের করে রাষ্ট্রপক্ষ। এ ধরনের আপিলের সংখ্যা ১৩৯টি। অন্যদিকে যাবজ্জীবন ও বিভিন্ন মেয়াদে সাজা পাওয়া প্রায় ৩০০ আসামি খালাস চেয়ে আপিল বিভাগে আপিল করেছেন। রাষ্ট্র ও আসামি পক্ষের এসব আপিল এখন চুড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায়। পরে এই আপিল দায়েরের বিষয়টি ব্যয় সাপেক্ষ হওয়ায় মেমো অব আপিলের মাধ্যমে আপিলের জন্য প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন করে আসামি পক্ষ। প্রধান বিচারপতি আসামি পক্ষের আবেদন মঞ্জুর করায় অন্যান্য আসামিদের পূর্ণাঙ্গ পেপারবুক ছাড়াই আপিল দায়ের করার সুয়োগ হয়েছে। ফলে তাদের কাউকে ১০ লাখ টাকা থেকে ১২ লাখ টাকা ব্যয় করে আপিল দায়ের করতে হবে না। তারা বড় অংকের অর্থ খরচের হাত থেকে বেঁচে গেছেন বলে জানিয়েছেন আসামি পক্ষের অন্যতম আইনজীবী এম আমিনুল ইসলাম।
বিস্ফোরক আইনের মামলা: ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে বিস্ফোরক আইনের মামলাটি। এই মামলায় আসামি রয়েছেন ৮৩৪ জন। এর মধ্যে একজন সিভিলিয়ান, বাকি আসামিরা বিডিআরের জওয়ান। এই মামলায় আসামিদের মধ্যে ২৪ জন মারা গেছেন। জীবিত আসামি ৭৯০ জন। পলাতক রয়েছেন ২০ জন আসামি। এই মামলায় ২৫৫ জন সাক্ষী দিয়েছেন।
মামলার বিচার কার্যক্রম কবে নাগাদ সম্পন্ন হবে, জানতে চাইলে মামলার পাবলিক প্রসিকিউশন (পিপি) মোশারফ হোসেন কাজল বলেন, এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রায় ১২০০ সাক্ষী রয়েছেন। সবার সাক্ষ্যগ্রহণের প্রয়োজন নেই। এই মামলাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বিস্ফোরক ও আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যা করা হয়েছে। মামলায় আসামি পক্ষ যদি সহায়তা করে, তাহলে এ বছরেই এই মামলার রায় দিতে পারবে আদালত।