রমজান মাস নৈতিক চরিত্র গঠনের অনন্য সুযোগ
মানব জীবনে সুন্দর চরিত্র গঠনে রমজান মাস, রোজা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রোজা একটি শারীরিক ও আধ্যাত্মিক ইবাদত। এর ব্যাপক উপকারিতা রয়েছে । রোজা পালনকারীকে তাকওয়া অর্জনে এবং আল্লাহর প্রিয় বান্দা হতে সাহায্য করে এবং শয়তানী শক্তি ও মন্দ প্রবণতার শক্তিকে দুর্বল করে। রমজান মাস হলো ভালো চরিত্র গঠনের সর্বোত্তম ঋতু। ভালো চরিত্রের অর্থ হলো আল্লাহর ভয়, ধৈর্য, সহনশীলতা, করুণা, পরোপকার, কৃতজ্ঞতা, লেনদেনে স্বচ্ছতা ইত্যাদি। এই মাসে ইবাদতের প্রধান কাজ হলো রোজা। রোজার মাধ্যমে মানুষ নিজেকে ভালো চরিত্রের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। ভালো চরিত্র গঠনে রোজার ভূমিকা অপরিসীম। মানব দেহে শয়তান যে শিরা ও ধমনী দিয়ে চলাচল করে, সেগুলি রোজার ফলে নিস্তেজ ও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। রোজা হলো আল্লাহর কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ এবং ইবাদতের প্রশিক্ষণ।
অশ্লীলতা এড়িয়ে চলার সুযোগ
মিথ্যা বলা, পরচর্চা এবং অপবাদ রোজাদারের জন্য নিষিদ্ধ। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রোজা রেখে মিথ্যা বলা এবং সে অনুযায়ী কাজ করা থেকে বিরত থাকে না, তার উপবাস করাতে কোন প্রয়োজন নেই আল্লাহর।’ (বুখারি)
রোজাদার ব্যক্তি কখনো ওজন কমাতে পারে না, দুর্নীতি করতে পারে না, মদ্যপান করতে পারে না। সে এসব কথা ভাবতেও পারে না। কেউ যদি রোজাদারের সাথে কোনভাবে ঝগড়া করে, তাহলে তার চুপ থাকা উচিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যদি কেউ রোজাদারের সাথে ঝগড়া করে বা মারামারি করে, তাহলে তার বলা উচিত, “আমি রোজাদার।” (নাসাঈ শরীফ )
আল্লাহর ভয় সৃষ্টি
রোজার মূল উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর ভয় অর্জন করা। অতএব, পূর্ববর্তী সকল নবী এবং তাদের অনুসারীরা আল্লাহর ভয় অর্জনের জন্য রোজা রাখতেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ, তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরজ করা হয়েছিল, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো ( আল্লাহকে ভয় করতে শিখ)।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৩)
উদাহরণস্বরূপ, রমজান মাসে, একজন রোজাদার ক্ষুধা বা তৃষ্ণার কারণে একাকী থাকলেও পানাহার করেনা , অথচ তখন নিষিদ্ধ কিছু করার সুযোগ নিতে পারে। কিন্তু কেউ তা করে না। বরং তারা আল্লাহর ভয়ে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করে। এক সেকেন্ড আগেও তারা ইফতার করার সুযোগ নেয় না। এটি তাকওয়ার এক অনন্য উদাহরণ। কারণ আল্লাহ সর্বদ্রষ্টা এবং সর্বশ্রোতা। এই ভয় তখন ভালোভাবে মনে কাজ করে।
রোজা হলো আল্লাহর প্রতি সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ
আল্লাহর আনুগত্যে ধৈর্য এবং নিষিদ্ধ জিনিস থেকে দূরে থাকার ক্ষেত্রে সহনশীলতার প্রশিক্ষণ। এটি আল্লাহর আনুগত্যে বিশ্বাসকে শক্তিশালী করে এবং বান্দার উপর আল্লাহর সার্বক্ষণিক নজরদারির অনুভূতি তৈরি করে। এই কারণে, রোজাদার গোপনে, এমনকি মানুষের চোখের আড়ালেও কিছু খায় না বা পান করে না।
এটি পার্থিব আনন্দের প্রলোভন কমায়
রোজা তার সাধককে আখেরাতের দিকে ঝুঁকতে সূচিত করে এবং তার ইবাদতের ক্ষেত্রকে প্রসারিত করে। রোজার ফলে বান্দা ভালো গুণাবলী এবং ভালো চরিত্র অর্জন করে।
পবিত্র রমজান মাস বান্দাকে শৃঙ্খলা ও সময়ানুবর্তিতা শেখায়
রোজা পাকস্থলী ও পরিপাকতন্ত্রকে বিশ্রাম দেয়। ফলস্বরূপ, এর কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায় এবং এটি আবার সতেজ ও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। রোজা স্থূলকায় ব্যক্তিদের স্থূলতা কমাতে সাহায্য করে। এটি অতিরিক্ত ওজন কমায় এবং অনেক রোগ থেকে রক্ষা করে। অনেক অভিজ্ঞ চিকিৎসকের মতে, রোজা ডায়াবেটিস এবং গ্যাস্ট্রিক রোগের জন্য একটি ফলপ্রসূ এবং সহজ চিকিৎসা। রোজা সারা বছর ধরে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ এবং অন্যান্য জীবন্ত কোষকে দুর্বল করে এমন জৈব বিষকে শুদ্ধ করে এবং সমগ্র রক্তসংবহনতন্ত্রকে একটি নতুন চেহারা দেয়। এবং এভাবে পবিত্র রমজান মাস বান্দাকে শৃঙ্খলা ও সময়ানুবর্তিতা শেখায়।
রোজা মানুষ সামাজিক করে তোলে
সামাজিকভাবে, রোজা সমাজের দরিদ্র মানুষের জন্য। রোজা ব্যক্তিকে মিথ্যা, হিংসা, ঝগড়া, অশ্লীলতা ইত্যাদি থেকে দূরে রাখে, যা একটি আদর্শ সমাজের ভিত্তি স্থাপনে ভূমিকা পালন করে। রোজার ফলে মানুষ অপচয় এবং অপচয়ের পথ থেকে মিতব্যয়িতার পথে চলে যায়।
রোজা সামাজিক সংস্কারের একটি অনন্য শিক্ষা
এটি সমাজকে পবিত্র ও সংস্কারে ভূমিকা পালন করে। কারণ ব্যক্তির পবিত্রতা হলো সমাজের পবিত্রতার প্রথম ধাপ। ব্যক্তি যদি সংস্কার করা হয়, তাহলে সমাজ সংস্কার করা হবে।
রমজান মাস হলো মহিমা ও পুণ্যে পরিপূর্ণ
মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘সবকিছুরই একটি প্রবেশপথ আছে এবং ইবাদতের প্রবেশদ্বার হলো রোজা।’ এক মাস রোজা স্বাস্থ্যের আবর্জনা ও ময়লা দূর করে, দৈনন্দিন জীবনকে পরিষ্কার ও সুন্দর করে তোলে এবং শরীর গঠনের বৈজ্ঞানিক নিয়ম শেখায়।
সকল ইবাদতের জন্য একটি সুন্দর মন অপরিহার্য। রমজান মাসে আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয়। অসংখ্য সওয়াবের ঝর্ণাধারা উপচে পড়ে। সমাজে শান্তির গভীর ছায়া নেমে আসে।
রোজা পাপমুক্ত হওয়ার পাথেয়
রমজান মাস হলো অতীতের পাপ ক্ষমার মাস। রমজান আমাদের জন্য যে, উপহার এনেছে তা অর্থহীন রোজা রেখে আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত করা উচিত নয়। বরং রহমত, ক্ষমা এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের আশায় তা ব্যয় করা উচিত। তাই, মহানবী (সা.) আমাদেরকে ঈমানের সাথে এবং ক্ষমার আশায় রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে এবং সওয়াবের আশায় রোজা রাখে, তার অতীতের সকল পাপ ক্ষমা করা হবে।’ (আবু দাউদ)
ভাবগাম্ভীর্যময় পরিবেশ সৃষ্টিতে রোজা অনন্য ইবাদত
আল্লাহভীতি এবং ভ্রাতৃত্বের অনন্য সমন্বয়ে একটি গম্ভীর পরিবেশ তৈরি হয়। যদিও শ্রেণী এবং পেশার উপর নির্ভর করে মানুষের রুচি ভিন্ন, রমজানে একই পরিবেশে সকলেই একই রকম আচরণ করে। পারস্পরিক ভালোবাসা, সম্প্রীতি এবং আন্তরিক পরিবেশ তৈরি হয়। অতএব, এই মাসকে শাহরুল মুআছাত বা করুণা ও সহানুভূতি প্রদর্শনের মাসও বলা হয়।
পরিশেষে বলা যায় রোজা মুমিনকে পবিত্র করে। এটি দুর্নীতিমুক্ত জীবন গড়ে তুলতে সাহায্য করে। এটি তাকে খাঁটি সোনার মানুষে পরিণত করে। রোজা একজন ব্যক্তিকে নিন্দনীয় চরিত্র থেকে দূরে রাখে এবং তাকে ভালো চরিত্রের বিভিন্ন শাখায় উন্নীত করে। অতএব, মানব জীবনে ভালো হওয়ার কোন বিকল্প নেই।