আইয়ামে জাহেলিয়াত প্রতিষ্ঠা করে গেছে আ.লীগ সরকার: আয়নাঘর পরিদর্শনকালে ড.মুহাম্মদ ইউনূস
আইয়ামে জাহেলিয়াত:
আইয়ামে জাহিলিয়াত হলো আরবি শব্দ যার অর্থ অজ্ঞতার যুগ । এটি দুটি শব্দ নিয়ে গঠিত। প্রথমটি হলো আইয়াম– যার অর্থ – দিন, দিবস, রাত ইত্যাদির বিপরীত। তবে, এখানে আইয়াম ব্যবহার করা হয়েছে যুগ বোঝাতে। আর জাহিলিয়াত মানে – অজ্ঞতা, বর্বরতা, কুসংস্কার, অন্ধকার বা তমসা ইত্যাদি। অর্থাৎ আইয়ামে জাহেলিয়াত বা অজ্ঞতার যুগ বলা হয় প্রাক-ইসলামিক যুগকে।
- হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুওয়তের (৫১০-৬১০ খ্রিস্টাব্দ) এক শতাব্দী আগে নবী, ঐশী গ্রন্থ এবং ধর্মীয় চেতনার অনুপস্থিতিতে আরব জাতির যে রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পতন ঘটেছিল তাকে ‘আইয়ামে জাহেলিয়াত’ বা অজ্ঞতার যুগ বলা হয়।
- সেযুগে মানবতা এতটা নিম্নস্তরে পৌঁছে ছিল যে, তারা সমাজের কটুক্তির ভয়ে নিজ মেয়েকে জীবন্ত কবর দিয়ে ফেলতো। আর এখন ড.ইউনূস এটা বুঝতে পেরেছেন যে, জীবন্ত কবরের একটি প্রতিচ্ছবি বাংলাদেশের আয়নাঘর।
- এই জাহেলিয়াতের অন্যতম কর্ণধার ফেরাউন, নমরুদ, হিটলার আর স্ট্যালিনের উত্তরসূরী কুখ্যাৎ খুনি হাসিনা একরকম কবরের মতই আয়নাঘরে মানুষকে শাস্তি দিতেন। তাই তিনি আগাগোড়া পুরাটাই অমানবিকতায় ভরপুর আওয়ামী লীগকে আইয়ামে জাহেলিয়াতের সাথে তুলনা করেন।
ডঃ মুহাম্মদ ইউনূস বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) ‘আয়নাঘর’ নামে পরিচিত যৌথ বাহিনীর আটক কেন্দ্র পরিদর্শন করছেন। তার সাথে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। উপদেষ্টা পরিষদের কিছু সদস্য এবং ভুক্তভোগীরাও উপস্থিত ছিলেন।
শান্তিতে নোবেলজয়ী ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, “আইয়ামে জাহেলিয়াত বলে একটা কথা আছে, গত সরকার (আওয়ামী লীগ সরকার) আইয়ামে জাহেলিয়াত প্রতিষ্ঠা করে গেছে সর্বক্ষেত্রে, এটা (আয়নাঘর) তার একটা নমুনা। “
ড. মুহাম্মদ ইউনূস আজ (১২ ফেব্রুয়ারি) বুধবার যৌথ বাহিনীর ‘আয়নাঘর’ নামে পরিচিত আটক কেন্দ্র পরিদর্শন করছেন। এ সময় দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরাও তার সাথে ছিলেন। উপদেষ্টা পরিষদের কিছু সদস্য এবং ভুক্তভোগীরাও উপস্থিত ছিলেন। আয়নাঘর পরিদর্শনের পর প্রধান উপদেষ্টা সাংবাদিকদের একথা বলেন।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের তথ্য অনুযায়ী, গোপন আটক কেন্দ্রগুলি আগারগাঁও, কচুক্ষেত এবং উত্তরা এলাকায় অবস্থিত।
প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “আপনারা সবাই সঙ্গে ছিলেন, কাজেই আমার নতুন করে কিছু বলতে হবে না। এটার বর্ণনা যদি বলতে হয়, তাহলে বলব এটা বীভৎস দৃশ্য। নৃশংস অবস্থা, অতীতে এখানে যেসব অবস্থা হয়েছে। যতটা শুনি অবিশ্বাস্য মনে হয়। এটা কি আমাদেরই জগৎ, আমাদেরই সমাজ? যারা এর (গুম) শিকার হয়েছে, তারা আমাদের সঙ্গে আছেন, তাদের মুখ থেকে শুনলাম কী হয়েছে তাদের সঙ্গে, কোনেও ব্যাখ্যা নেই এর। কোনও ব্যাখ্যা থাকলে মানুষ বুঝে এর কোনও কারণ ছিল। বিনা কারণে মানুষকে রাস্তা থেকে তুলে আনা হয়েছে।“
প্রফেসর ইউনূস আরও বলেন, “এ রকম টর্চার সেল বাংলাদেশজুড়ে আছে, আজকে সেটা শুনলাম। আমার ধারণা ছিল, আয়নাঘর বলতে কয়েকটি আছে এখানে। এখন শুনতেছি এই আয়নাঘরের বিভিন্ন ভার্সন দেশজুড়ে আছে। কেউ বলছে ৭০০, কেউ বলছে ৮০০, এটির সংখ্যাও নিরুপন করা যায়নি।“
গত বৃহস্পতিবার (৬ ফেব্রুয়ারি), উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে প্রধান উপদেষ্টা দেশি-বিদেশি গণমাধ্যম কর্মীদের নিয়ে আয়নাঘর পরিদর্শন করবেন। এক সপ্তাহ পর, আজ তারা গোপন আটক কেন্দ্র আয়নাঘর পরিদর্শন করেন। এবং ছবিগুলো প্রকাশ্যে আসে।
প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, “আমার জানামতে ভুক্তভোগীদের সংখ্যা ১৭০০ এর বেশি। অজানা কত তা তো আমরা জানি না। কেউ কেউ বলে যে এটা ৩ হাজারেরও বেশি হতে পারে। এই যে মানুষ উধাও হয়ে গেলো, নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলো, কেউ বলতে পারছে না, সে কোথাও। তার (ভুক্তভোগী) মেয়ে আজ আপনাদের সামনেই ছিল। সে বলছে আমার মাকে কোথায় নিয়ে গেছে, আজ নয় বছর হলো। নয় বছর ধরে আমরা খোঁজ পাইনি। সে নিজেও এখানে (আয়নাঘরে) ছিল। মায়ের সঙ্গে ছিল। তাকে রেখে মাকে নিয়ে চলে গেছে। এই দৃশ্য করুণ দৃশ্য।“
‘যারা এসব কাজ করেছে, তারা আমাদেরই ভাই, আমাদেরই সন্তান, আমাদেরই ঘনিষ্ঠ আত্মীয়’— উল্লেখ করে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, তারাই এসব করেছে। আমরা যদি এই সমাজকে এর থেকে বের করে আনতে না পারি, তাহলে তো এ সমাজ টিকে থাকবে না।“
সম্মানিত প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, “আমাদের সবারই অপরাধ, এটি (গুমের মতো ঘটনা) হতে দিয়েছি আমরা। আজকে আমরা মুক্ত হলাম। মুক্ত বাংলাদেশে আমরা যেন আবার নতুন সমাজ গড়তে পারি। এটার যে নমুনা, সাক্ষী, ডকুমেন্টেশন, গুম কমিশনের রিপোর্টের মধ্যে থাকবে। এবং এটি পাঠ্য হিসেবে অবশ্যই পড়তে হবে। আর যারা করেছে, তাদের বিচার করতে হবে। তা না হলে এ জাতি নিষ্কৃতি পাবে না।“
সবশেষে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “যারা করেছে তাদের জন্য আমরা কেন ভুক্তভোগী হতে যাব? তাদের বিচার করব, ভবিষ্যতে বলবে যে, উচিত বিচার হয়েছে। তখন আমরা এটি থেকে মুক্তি পাব। সবার কাছে আমাদের আবেদন, এই বিচারটি যেন আমরা করে ফেলতে পারি। আমরা যেসব এভিডেন্স দেখলাম, সেগুলো সিলগালা করে দেয়া হবে, যাতে কেউ এগুলো বিনষ্ট করতে না পারে।“
আয়না ঘর পরিদর্শনের সময় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ছিলেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, উপদেষ্টা মাহফুজ আলম, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।
পরিদর্শনকালে গত জুলাই মাসে আন্দোলনের সময় সাদা পোশাকে তুলে নেওয়ার পর ডিজিএফআইয়ের টর্চারসেলে যে কক্ষগুলোতে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামকে রাখা হয়েছিল, সেগুলো তারা চিহ্নিত করেন।