ঢাকা ওয়াসার তাকসিম চক্র লোপাট করেছে ৫০০০ কোটি টাকাঃ দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
ঢাকা ওয়াসা ভবনে তাকে ডন বলা হয়। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামকে তার পকেটমন্ত্রী বলা হতো। ওয়াসার সাবেক এমডি তাকসিম এ খানকে মন্ত্রী ও কর্মকর্তাদের ভয় পেতেন। সম্রাট তাকসিম চলে গেলেও তার উজির নাজির পাইক পেয়াদা র্যামস ও বাঁছুর গ্রুপ হিসেবে রয়ে গেছেন। তাদের কারণেই গত ১৫ বছরে ওয়াসা বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে রাজস্ব হারিয়েছে। পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি দুর্নীতি হয়েছে। এদিকে পদত্যাগের পর তাকসিম এ খানের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সোমবার সংগঠনটির পক্ষ থেকে এ সংক্রান্ত একটি চিঠি পুলিশের বিশেষ শাখায় পাঠানো হয়েছে। দুদকের একটি ঊর্ধ্বতন সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। একজন কর্মকর্তা বলেন, তাকসিম এ খানের বিরুদ্ধে প্রকল্পে অর্থ আত্মসাৎ ও দুর্নীতিসহ বেশ কয়েকটি অভিযোগ তদন্ত করা হচ্ছে।
সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তার বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে ইমিগ্রেশনে চিঠি পাঠানো হয়েছে। এর আগে গত বছরের ২৩ মে ওয়াসায় অবৈধ নিয়োগের অভিযোগ তদন্ত করে মামলার অনুমোদনের সুপারিশ চেয়ে প্রতিবেদন দাখিল করেন দুদকের উপ-পরিচালক সৈয়দ নজরুল ইসলাম। তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে যে, পরিচালক (উন্নয়ন) ও পরিচালক (কারিগরি) দুটি পদ ওয়াসার অর্গানাইজেশন চার্টে না থাকলেও কোম্পানির এমডি তাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে প্রভাবিত করেছেন। আর চার বছরের বেশি সময় ধরে তাদের বেতন বাবদ ১ কোটি ৯৮ লাখ ৬৫ হাজার ৯৮০ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।
অবৈধ নিয়োগের কারণে এই টাকা আত্মসাৎ করা হয়। দুদক সূত্রে জানা গেছে, প্রকৌশলী তাকসিম এ খান ২০০৯ সালে ঢাকা ওয়াসার এমডি হিসেবে নিয়োগ পান। এরপর বেশ কয়েকবার তিনি ওই পদে রয়েছেন। তার বিরুদ্ধে বারবার নিয়োগ বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়া পদ্মা-জশালদিয়া প্রকল্পে প্রায় ১১০০ কোটি টাকা, গন্ধর্বপুর পানি শোধনাগার প্রকল্পে এক হাজার কোটি টাকা, দশেরকান্দি পয়ঃনিষ্কাশন প্রকল্পে এক হাজার কোটি টাকার অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে ওয়াসার এমডিসহ অন্যদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। প্রকল্প, গুলশান-বারিধারা হ্রদ দূষণ প্রকল্পে ৫০ কোটি টাকা। দুদকের প্রধান কার্যালয়ের উপ-পরিচালক সৈয়দ নজরুল ইসলাম এ বিষয়ে তদন্ত করছেন।
এদিকে তাকসিম চলে গেলেও তার দুর্নীতি সিন্ডিকেট র্যামস ও বাচুর গ্রুপ এখনো টিকে আছে। তারা ইতিমধ্যে তাকসিমের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে তাকসিমের দুর্নীতির ফাইল গায়েব করার কাজ করছে। সম্প্রতি ওয়াসার এমডি পদ থেকে পদত্যাগের পর তাকসিমপন্থী কর্মকর্তাদের ওপর ক্ষুব্ধ ঢাকা ওয়াসার সাধারণ কর্মীরা। তাদের মারধর ও হয়রানির চেষ্টা করলে বিএনপিপন্থী কর্মকর্তারা এসে তাদের রক্ষা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ঢাকা ওয়াসা সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার আগের দিন ৪ আগস্ট পর্যন্ত অফিসে ছিলেন তাকসিম এ খান। এরপর থেকে তাকে আর অফিসে দেখা যায়নি। সে সময় জনরোষের ভয়ে নিজ বাড়িতে না থেকে রাজধানীর পাঁচ তারকা হোটেল প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁওয়ে ভিন্ন নামে একটি রুম বুক করে ওয়াসার দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সঙ্গে মেলামেশা করতেন। বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। সেখান থেকে তিনি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনলাইনে নির্দেশনা দিচ্ছেন। পরে তিনি রাজধানীর বসুন্ধরার একটি ফ্ল্যাটে আত্মগোপন করেন। সেখান থেকে তিনি তার অনুসারীদের নিয়ে ওয়াসার গুরুত্বপূর্ণ ফাইল উধাও করে দেন। সাথে কিছু ফাইল নিয়ে গেলেন। তাকসিমের ডান হাত হিসেবে পরিচিত ওয়াসায় কর্মরত বদরুল আলম মূলত এসব ফাইল সরানোর কাজ করছেন।
এদিকে ঢাকা ওয়াসার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান প্রতিষ্ঠানটিকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছেন। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রভাব বিস্তার করে তিনি সেখানে দুর্নীতির সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, তাকসিমের দুর্নীতিতে সক্রিয় ছিলেন এর স্টাফ অফিসার বদরুল আলম। তিনি তরুণ নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমানকে ৬ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের পিডি করেন। নির্বাহী প্রকৌশলী জয়নাল আবেদীন গত ৬ বছরে টেন্ডারবাজি, লুটপাটসহ সব ধরনের দুর্নীতি করেছেন। এই তিনজনই গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন। আর সবাই বড় বড় প্রকল্পে জড়িত। ওয়াসায় এদের বলা হয় বাঁছুর গ্রুপ। তাদের আগে গত ৮ থেকে ৯ বছর ধরে যারা তাকসিম দুর্নীতির নেতৃত্ব দিয়েছিল তাদের বলা হতো র্যামস গ্রুপ। এই গ্রুপের সদস্য রফিকুল ইসলাম পদ্মা প্রকল্পের ডিজি ছিলেন। তার বিরুদ্ধে শত শত কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। এই গ্রুপের আরেক সদস্য অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আকতারুজ্জামান। বর্তমানে তিনি অবসরপ্রাপ্ত। তিনি প্রজেক্টের পিডিও ছিলেন। তার বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ রয়েছে। রফিকআক্তারকে দুদকে ডাকা হলেও তাকসিন তার ক্ষমতার প্রভাব বিস্তার করে চাপা দিয়ে রেখেছেন। আরেক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোহসেন আলী মিয়া দাসেরকান্দি প্রকল্পের পিডি ছিলেন। তিনিও বর্তমানে অবসরে আছেন। তার বিরুদ্ধে ৩৫০০ কোটি টাকা দুর্নীতি ও লুটপাটের অভিযোগ রয়েছে।
বর্তমান এসি সুপারিনটেনিং ইঞ্জিনিয়ার আব্দুর সাত্তার সবুজ। তার বিরুদ্ধে টানা ৯ বছর সংগ্রহ বিভাগে (ক্রয়) শত শত কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।
এখন প্রথম কথা হলো সাবেক এমডি তাকসিম পদত্যাগ করলে তা হবে না। সে বিশ্বের যেখানেই থাকুক না কেন আমাদের আইন ও আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী তাকে জবাবদিহির আওতায় আনা সম্ভব এবং অবশ্যই প্রয়োজন। এর মাধ্যমে জনস্বার্থে একটি নজির স্থাপন করা দরকার। সে একাই অনিয়ম-দুর্নীতি করেছে এটা বলার কোনো সুযোগ নেই। তার সঙ্গে এই সংগঠনের একটি চক্র ছিল। যারা ক্ষমতায় থাকলে নিজেদের ও তাকসিমের দুর্নীতি রক্ষার চেষ্টা করবেন। এ ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের নেতৃত্বে তা ঠেকানোর সুযোগ রয়েছে। আর যারা এসব দুর্নীতিমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে তাদেরও চিহ্নিত করে বিচার ও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।