টালমাটাল বাংলাদেশে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী বাহিনীর যৌথ হামলায় আন্দোলনকারী ৬ ছাত্র নিহত, আহত শত শত
এক কথায় বাংলাদেশে ছাত্ররা কোটা সংস্কার নিয়ে আন্দোলন করছে। এ আন্দোলন আওয়ামী লীগ বা তাদের পালিত বাহিনী ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে নয়। পুলিশ বা প্রশাসনের বিরুদ্ধে নয়। এটা তাদের নিজস্ব যৌক্তিক এবং স্বীকৃত প্রাপ্ত অধিকার । সে অধিকার যদি নিজেদের বিরুদ্ধে বলে প্রচারণা করে সেটা সরকার মহল হোক আর যে কোন মহলই হোক না কেন সেটা কোনদিনও স্থায়ী হতে পারে না, এবং পারবেওনা। সেটাই আশা করছে বাংলার মেধাবী ছাত্ররা। এবং এই টালমাটাল বাংলাদেশে মেধাহীন একদল সন্ত্রাসীদের হাতে জীবন দিলেন ভবিষ্যতের ৬ জন উজ্জ্বল নক্ষত্র।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়েছে। সোমবার শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনায় মঙ্গলবার সারাদেশে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষার্থীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করে রাস্তায় নেমে সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ করে।
গতকালও দেশের বিভিন্ন এলাকায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা হয়েছে। সরকার সমর্থক বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়েছে। এসব ঘটনায় চট্টগ্রামে তিনজন, রাজধানীতে দুইজন ও রংপুরে একজনসহ মোট ছয়জন নিহত হয়েছেন। আহতের সংখ্যা চার শতাধিক।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গতকাল বিকেলে ঢাকা, চট্টগ্রাম, বগুড়া, রংপুর ও রাজশাহীতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মোতায়েন করা হয়েছে।
এদিকে গতকাল রাতে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীদেরও আবাসিক হল ত্যাগ করতে হয়। এ বিষয়ে নির্দেশনা দিতে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের চিঠি দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সকল মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি প্রতিষ্ঠান) এবং পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ক্লাস কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলিও পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ থাকবে। এ ছাড়া আগামীকাল বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিতব্য সব শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।
এর আগে সোমবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ। এর প্রতিবাদে মঙ্গলবার দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ কর্মসূচির ডাক দেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। এর প্রতিক্রিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেছে।
রাজধানী ঢাকায় লাঠিসোঁটা ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে বিক্ষোভ দমনে তৎপর ছিল ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ১৬টি স্থানে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছে শিক্ষার্থীরা। দুপুর দুইটার পর থেকে রাজধানীর সঙ্গে রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে ঢাকা কলেজ, সায়েন্স ল্যাব, পুরান ঢাকা, নতুন বাজার ও মিরপুর এলাকায় আন্দোলনকারী ও সরকার সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, সংঘর্ষ, গুলি ও হামলার ঘটনা ঘটেছে।
ঢাকা কলেজের সামনে আহত এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। ঢাকা সিটি কলেজের সামনে আহত অপর একজনকে হাসপাতালে নেওয়ার পর মৃত ঘোষণা করা হয়। একজনের পরিচয় পাওয়া যায়নি। আরেকজন হলেন নিউমার্কেট এলাকার ফেরিওয়ালা মোঃ শাহজাহান (২৫)। সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল সেন্টারে আহত ১২৬ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। এছাড়া আহতদের মধ্যে কয়েকজন বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন বলে জানা গেছে।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এ সময় একজনকে অস্ত্র নিয়ে শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে গুলি করতে দেখা যায়। গতকাল বিকেলে চট্টগ্রামের মুরাদপুর এলাকায়।
চট্টগ্রামে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষে তিনজন নিহত হয়েছেন। নগরীর মুরাদপুরে শিক্ষার্থীদের ওপর বন্দুকধারীরা গুলি চালালে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
রংপুরে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর পুলিশ ও ছাত্রলীগের হামলা হয়েছে। এ সময় পুলিশের রাবার বুলেটে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী নিহত হন। আহত হয় শতাধিক শিক্ষার্থী। নিহত আবু সাঈদ (২২) রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কোটা আন্দোলনের সমন্বয়ক ছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস উত্তপ্ত
গতকাল দিনভর উত্তপ্ত ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জসহ ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে নেতাকর্মীদের নিয়ে ছাত্রলীগ গতকাল ক্যাম্পাসে অবস্থান নেয়। সংগঠনের নেতা-কর্মীদের হাতে ছিল হকি স্টিক, লাঠি, স্টাম্পসহ বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা শহীদ মিনার, দোয়েল চত্বর, ঢাকা মেডিকেল, কার্জন হল, চানখানারপুল এলাকায় বিক্ষোভ করে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হামলায় আহত শিক্ষার্থীরা। ঢাকার কয়েকটি এলাকায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও বিক্ষোভ করেছে। ঢাকার বাইরে ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেছে। ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও পুলিশ নেতা-কর্মীরা এ হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ আন্দোলনকারীদের।
সোমবার সন্ধ্যায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতা-কর্মীরা। পরে উভয় পক্ষের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। গভীর রাতে উপাচার্যের বাসভবন প্রাঙ্গণে পেট্রোল বোমা ও দেশীয় অস্ত্র দিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা ও মারধর করা হয়। পরে পুলিশ এসে টিয়ারশেল ও গুলি ছোড়ে। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন শতাধিক শিক্ষার্থী। এ ছাড়া ঘটনাস্থলে চার-পাঁচ শিক্ষক ও সাত সাংবাদিক আহত হয়েছেন। চোখে গুলি লেগে গুরুতর আহত হয়েছেন এক শিক্ষক। আহতদের অধিকাংশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। আর গুরুতর আহতদের সাভারের বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের প্রভোস্টের কক্ষ, ছাত্রলীগ নেতাদের কক্ষসহ অন্তত ১০টি কক্ষ ভাঙচুর করেছে আন্দোলনকারীরা। একপর্যায়ে ১৫টি মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেয় তারা। ছাত্রলীগের একাংশ হুড়োহুড়ি করে ক্যাম্পাস ত্যাগ করে।দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের সময় বিজিবি সদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে নগরীর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অন্তত দেড় হাজার শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে আসেন। দুপুর আড়াইটায় তারা নিজেদের আত্মরক্ষার্থে লাঠি হাতে ও স্লোগান দিতে দিতে ক্যাম্পাস থেকে মিছিল করে।
রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জে শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও বিক্ষোভ করেছে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।
আরও পড়ুন