জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাড়ছে ডেঙ্গু: বাড়ছে উদ্বেগ
জলবায়ু পরিবর্তন পরিবেশ ব্যবস্থাপনায় প্রভাব ফেলছে। পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ছে। ঋতু এবং বৃষ্টিপাতের ধরণ পরিবর্তন হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে বিভিন্ন রোগের সম্পর্ক রয়েছে, যার ফলে একই রোগ বিভিন্ন রূপে ও উপসর্গে প্রকাশ পায়। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে যেসব জায়গায় আগে মশা টিকে থাকতে পারত না সেখানে মশারা বসতি স্থাপন করছে। বেশি বৃষ্টির কারণে এডিস মশার প্রজনন বেশি হয়। ডেঙ্গু শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্বে জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে লাখ লাখ মানুষ খোলা আকাশের নিচে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব কোনো না কোনোভাবে নানা রোগের বিস্তারে ভূমিকা রাখছে।
নিঃসন্দেহে, ডেঙ্গু এখন বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্বের জন্য একটি জটিল উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এডিস মশাবাহিত রোগ হঠাৎ করে আসেনি। যতদূর জানা যায়, বাংলাদেশে এই ডেঙ্গু মূলত ঢাকা অঞ্চল থেকে ছড়িয়ে পড়ে। আমরাই এই নোংরা মহানগরীকে তৈরি করছি, যেটি প্রতিনিয়ত আমাদের জন্য মারাত্মক পরিবেশগত সমস্যায় ভুগছে।
শীর্ষ সাত দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ:
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে ২০২৩ সালে সাতটি দেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব তীব্রতর হবে। বাংলাদেশ ছাড়াও, ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব তীব্রতর হচ্ছে এমন দেশের তালিকায় রয়েছে ব্রাজিল, বুরকিনা ফাসো, ফিজি, পাকিস্তান, ফিলিপাইন এবং ভিয়েতনাম। কিছু দেশে ডেঙ্গু একটি জরুরি জনস্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘বৈশ্বিক পরিস্থিতি’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত দুই দশকে বিশ্বব্যাপী ডেঙ্গুর প্রকোপ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ২০০০ সালে, ৫ লাখ মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল, ২০১৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫২ লাখে। অর্থাৎ আক্রান্তের সংখ্যা ১০ গুণ বেড়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৩টি কারণে বিশ্বে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে। এগুলো হলো
১. এডিস মশা পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানোতে বাংলাদেশ সুন্দর আবাসভুমি,
২. অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং মশার আবাসস্থলের জন্য সহায়ক অন্যান্য কার্যক্রম,
৩. জলবায়ু পরিবর্তন ডেঙ্গু বাড়ার সহায়ক,
৪. রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে ভঙ্গুর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা,
৫. একাধিক ডেঙ্গু স্ট্রেনের একযোগে বিস্তার,
৬. ডেঙ্গু শনাক্ত করার জন্য নির্দিষ্ট লক্ষণের অভাব,
৭. সমস্যা, ল্যাবরেটরি ও টেস্টিং সুবিধার অপর্যাপ্ততা,
৮. কোভিড-১৯ এর সাথে একযোগে প্রাদুর্ভাব,
৮. ডেঙ্গুর সুনির্দিষ্ট চিকিৎসার অনুপস্থিতি,
৯. ডেঙ্গু সম্পর্কে জনগণের সচেতনতা ও আচরণের তথ্যের অভাব,
১০. সম্প্রদায়ভিত্তিক স্বাস্থ্য উদ্যোগ ও মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের অভাব,
১১. মশা নিয়ন্ত্রনের অভাব,
১২. নিয়ন্ত্রণ দক্ষতা, অবিরাম তহবিল ঘাটতি এবং
১৩. মানুষ ও পণ্যের ব্যাপক চলাচলের সাথে অংশীদারদের সমন্বয়ের অভাব।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডে ডেঙ্গুর প্রকোপ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। বলা হয়েছে, ২০২২ সালে বাংলাদেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ৬২ হাজার ৩৮২ জন। আর ২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ৩ লাখ ৮ হাজার ১৬৭ জন। গত বছরের তুলনায় বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডে সংক্রমণ বেড়েছে যথাক্রমে প্রায় ৪৯৪ ও ২৯৩ শতাংশ। একইসঙ্গে বাংলাদেশেও ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ২০২২ সালে বাংলাদেশে ২৮১জন মারা গেছে। মৃত্যুর হার ছিল০.৪৫ শতাংশ। ২০২৩ সালে, মৃত্যু এবং মৃত্যু উভয়ই বৃদ্ধি পেয়েছে। নভেম্বর পর্যন্ত মারা গেছেন ১ হাজার ৫৯৮ জন। তখন মৃত্যুর হার ছিল ০.৫২ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সাত বছর ধরে যে কৌশলপত্র প্রণয়ন করা হয়েছে তা নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ডেঙ্গু কমবে। ইতিমধ্যেই কিছু সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে সাফল্য এসেছে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সফলতা আসবে বলে মনে করেন তিনি।
চলমান ডেঙ্গু সংকট থেকে উত্তরণের জন্য এখন পর্যন্ত মশা নিয়ন্ত্রণে শুধুমাত্র রাসায়নিক ব্যবস্থাপনার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু রাসায়নিক ব্যবস্থাপনা নানাভাবে বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত সংকট সৃষ্টি করছে। জনসাধারণই এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস করার মূল চাবিকাঠি। কারণ বাড়িঘর, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে আমাদের চারপাশে এডিস মশার লার্ভার অনেক প্রজনন ক্ষেত্র রয়েছে। ডেঙ্গু বহনকারী এডিসের ডিম শীতকালেও থাকে।
কয়েক ফোঁটা বৃষ্টির পানি এসব ডিমে পড়ে এবং লার্ভা জন্মে। এডিস মশা শুষ্ক ও ভেজা উভয় ঋতুতেই সক্রিয় থাকে। তাই মশা ও মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। ঢাকা মহানগরীর প্রতিটি ওয়ার্ডে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
ওয়ার্ড সদস্যসহ যুবকদের নিয়ে স্বেচ্ছাসেবী দল গঠন করা যেতে পারে। মনে করুন যে, আপনার বাড়ির সামনের ড্রেন, রাস্তাঘাটসহ আশেপাশের এলাকা পরিষ্কার না থাকলে বা পানি থাকলে আপনাকে জবাবদিহি করতে হবে। তার আগে কর্তৃপক্ষকেও তাদের জবাবদিহিতার ব্যাপারে পরিষ্কার করতে হবে। কারণ কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহিতার চর্চা থাকলে জনগণও এক্ষেত্রে এগিয়ে আসবে।