বিশ্বে সবচেয়ে কম রাজস্ব আদায় বাংলাদেশে
গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, সরকারি ব্যয়ের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে পুরো বিনিয়োগই হয় ঋণের মাধ্যমে। গত ১৫ বছর ধরে সরকারের কোনো সঞ্চয় নেই, যা মোটেও ভালো কিছু নয়। কর আদায়ের প্রধান সমস্যা হল সরাসরি আদায় কম। মোট করের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ সরাসরি সংগ্রহ করা হয়।
মঙ্গলবার রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে ‘বাংলাদেশের ডোমেস্টিক রিসোর্স মোবিলাইজেশন- ইম্পারেটিভস অ্যান্ড এ রোডম্যাপ’ শীর্ষক সেমিনারে প্রতিবেদন উপস্থাপনকালে তিনি এ মন্তব্য করেন। পিআরআই আয়োজিত সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়েশা খান। সভাপতি হিসেবে ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান। এছাড়া বিশেষ অতিথি হিসেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম, এফবিসিসিআই সভাপতি মো. মাহবুবুল আলমসহ ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। তারা বলেন, বাংলাদেশে বর্তমানে যে বিনিয়োগ করা হয় তা ঋণের মাধ্যমে করা হয়।
সরকারি ব্যয়ের পাশাপাশি এই ঋণও বাড়ছে, যা ভালো কিছু নয়। যদিও এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনীম বলেন, অর্থ ঋণ নেগেটিভ নয়, উন্নয়নশীল দেশের জন্য এটা ভালো।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, জাতীয় আয়ের ৪৩ শতাংশ যায় বেতন, ভাতা ও পেনশনে, যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশে রাজস্ব আদায় মাথাপিছু আয়ের চেয়ে কম, যা অন্য কোনো দেশে দেখা যায় না। বলা যায়, বাংলাদেশের রাজস্ব আহরণ বিশ্বে সবচেয়ে কম। পৃথিবীর আর কোনো দেশে এত কম রাজস্ব আদায়ের দৃশ্য দেখা যায় না। পিআরআই বলছে, সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে ৯৫ লাখ কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। কিন্তু বর্তমান ভ্যাট আইনে তা ২৯ লাখ কোটি টাকার বেশি হবে না।
যদি সিস্টেম পরিবর্তন করা যায়, তাহলে ৭৮ লাখ কোটি টাকা পর্যন্ত আয় হবে। সেক্ষেত্রে স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ প্রয়োজনীয় সব খাতে ব্যয় বাড়ানো সম্ভব হবে। পুরোনো ভ্যাট আইনে ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে পিআরআই পরিচালক বলেন, “২০১২ সালের ভ্যাট আইন সঠিক ছিল। এটি এখন দাঁড়িয়েছে, অ্যাক্সেস ডিউটির একাধিক স্তর রয়েছে। যা বিভিন্ন পর্যায়ে ক্ষতিকর। তাই আমাদের ২০১২ সালের ভ্যাট আইনে ফিরে যেতে হবে। তাহলে ভ্যাট ব্যবস্থা পুরোপুরি কাজ করবে। দেশের আর্থিক খাতের উন্নতি হতে আরও তিন বছর সময় লাগবে উল্লেখ করে আহসান এইচ মনসুর বলেন, দেশের আর্থিক খাত এমনিতেই ছোট, সেটা আরো ছোট হচ্ছে।
আর্থিক খাতের উন্নয়নে যেসব উদ্যোগ নেওয়া দরকার তা এখনই নেওয়া হলেও তা কার্যকর হতে অন্তত তিন বছর সময় লাগবে। সেটা আইএমএফও জানে। এফবিসিসিআই সভাপতি মোঃ মাহবুবুল আলম বলেন, যেসব ব্যবসা এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের বাইরে, সেগুলো খুবই ভীতিকর। তাদের কর আদায়ের নিয়মের আওতায় আনতে হবে। শুধু ঢাকা ও চট্টগ্রামের ওপর নির্ভর করলেই হবে না। কর নীতি অটোমেশন প্রবর্তনের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, কর নীতি ও আদায়ের নিয়ম অনুযায়ী অটোমেশন ব্যবস্থা চালু করতে হবে। অটোমেশন হলে কর আদায় বাড়বে।
ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ব্যবসায়ীরা কয়েক বছর ধরে লোকসানের মুখে পড়েছেন। সেজন্য এই ক্ষতি পূরণের জন্য প্রণোদনা প্রয়োজন। তিনি বলেন, ব্যাংকের সুদের হার প্রতিনিয়ত বাড়ছে। যদি এটি ১৪ শতাংশের বেশি হয় তবে এটি টেকসই হবে না। মাহবুবুল আলম বলেন, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ ছাড়া আমরা উৎপাদন ধরে রাখতে পারব না। ডলারের সংকট এখনো আছে। গত ৪-৫ বছরে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাই আমরা আগামী অর্থবছরের জন্য একটি ব্যবসাবান্ধব বাজেট আশা করছি। কর অনুপাত নিয়ে হতাশ না হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা। রহমাতুল মুনিম বলেন, জিডিপির তুলনায় কর অনুপাত নিয়ে অনেকেই হতাশা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু আমি এখানে কোনো হতাশা দেখছি না।
বাংলাদেশকে অন্যান্য দেশের সাথে তুলনা করতে হবে যার সাথে তুলনা করা হয়। টাকা ধার করার বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘টাকা ধার নেওয়া নেতিবাচক নয়, এটা উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য ভালো কিছু। আপনি যদি নিজের টাকা দিয়ে কাজ করেন তবে আপনি ধীরে ধীরে উন্নতি করবেন, কিন্তু আপনি যদি ঋণ নিয়ে কাজ করেন তবে আপনি অনেক দ্রুত বিকাশ করতে পারবেন। প্রধান অতিথির বক্তব্যে অর্থ প্রতিমন্ত্রী বলেন, বড় বড় অবকাঠামো থেকে রিটার্ন আসা শুরু হয়েছে, যা জিডিপিতে অবদান রাখছে। ২০০৯-১০ থেকে অর্থনীতি যে অবস্থায় পৌঁছেছে তা স্বল্প সময়ের মধ্যে ঘটেনি। এ সময় তিনি ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ব্যবসায়ীদের এমনও কর সুবিধা দেয়া হয়েছে যা ২৫ বছর আগের। এত বছর ধরে সুবিধা অব্যাহত রাখার কোনো প্রয়োজন নেই। ব্যবসায়ীদেরকেও সে বিষয় খেয়াল করতে হবে।