ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দিলেন হিন্দু ব্রাহ্মণ ড. পিনাকী ভট্টাচার্য
মায়ানমার, পাকিস্তান, নেপাল, আফগানিস্তান, ভুটান, চীন ও বাংলাদেশ এই সাতটি দেশের সাথে ভারত তার সীমানা রয়েছে, কিন্তু এই ক্ষেত্রে ভারতের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হল এই সাতটি দেশের কারো সাথেই ভারতের সুসম্পর্ক নেই । সবার সাথেই ভারতের বৈরী সম্পর্ক। তার মধ্যে বাংলাদেশের সাথে তো আছেই । এবং বাংলাদেশের সীমানায় সবচেয়ে বেশি খুন করেছে ভারতের বিএসএফ নামক সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনী।
ড. পিনাকী ভট্টাচার্য, প্যারিসের একজন নির্বাসিত এবং আলোচিত কর্মী, দেশের জনগণকে ভারতীয় পণ্য বয়কট করার আহ্বান জানিয়ে, ৭ই জানুয়ারির বিতর্কিত ও একতরফা নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে সাহায্য ও সমর্থন করার অভিযোগে ভারতকে নির্লজ্জ সাহায্য করার অভিযোগ তুলেন। আর অবৈধভাবে ক্ষমতার মসনদে বসে আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়ে দেশকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে এই ভারত । তাই ভারত ভ্রমণ এড়িয়ে চলারও আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
বুধবার তার ইউটিউব চ্যানেলে পিনাকী বলেন, ‘আমরা ১৮ কোটি জনগণ, আমরা কিনতে পারি, আমরা ক্রেতা আমাদের কেনার শক্তিতে ইন্ডিয়া শক্তিশালী হইতেছে, সে আর্থিকভাবে শক্তিশালী হইয়া আমাদের অধিকার হারা করিছে, সে হাসিনাকে সাপোর্ট করিচ্ছে, আমাগির টাকা নিয়া হাসিনাকে সাপোর্ট করি। আমরা আজ থিকা, এই মুহূর্ত থিকা, ইন্ডিয়ার পণ্য বয়কটের ঘোষণা দিলাম। আমরা মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত ইন্ডিয়ান প্রোডাক্ট বয়কট করব। মিছিল করতে হবে না, মিটিং করতে হবে না, রক্ত দিতে হবে না, জেলে যাইতে হবে না, শান্তিপূর্ণ বয়কট ইন্ডিয়া মাইনকে চিপা পড়বে শুধু আও আও করবে, কিছু বলবার পারবে না।’
এভাবে পিনাকী ভট্টাচার্য বগুড়ার স্থানীয় ভাষায় ‘ভারত বয়কট’ ঘোষণা করেন। আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন দমন-পীড়ন, অসঙ্গতি ও অনিয়ম নিয়ে তিনি নিয়মিত ভিডিও করেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর সরকারের রোষানলে পড়ে পিনাকী দেশ ছাড়তে বাধ্য হন।
শুরুতে ফেসবুকে লেখালেখি করলেও পরে বাংলাদেশের রাজনীতি, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে নিয়মিত ভিডিও প্রকাশ করতে থাকেন।
এম বি বিএস ডাক্তার পিনাকী ভট্টাচার্য বুধবার ‘হোক পাল্টা আঘাত’ শিরোনামের ভিডিওতে ভারতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্কের সমালোচনা করে বলেন, আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের দল। আওয়ামী লীগ গর্ব করে প্রচার করছে যে বাংলাদেশ হবে ভারতের চতুর্থ বৃহত্তম বাজার। তার মানে ভারত বাংলাদেশের রপ্তানি বাজার হবে না। বাংলাদেশ হবে ভারতের রপ্তানি বাজার। আর এটা বাংলাদেশের একটা রাজনৈতিক দল বলছে। এটা বলেছে ভুল। আমরা এখনই চতুর্থ বৃহত্তম রপ্তানি বাজার ভারতের। আমরা তৃতীয় বৃহত্তম রপ্তানি বাজার হব ভারতের। ভারত বাংলাদেশে ২০২১-২২ অর্থ বছরে ১৪.৫৮ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করেছে, বিপরীতে বাংলাদেশ ভারতে মাত্র ১.৮ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করে। অর্থাৎ ভারত এখানে তাদের পণ্য বিক্রি করে বছরে ১৩ বিলিয়ন টাকা নিয়ে যায়। এ ছাড়া করোনার আগে ২০১৯ সালে ভারত বাংলাদেশিদের থেকে ট্যুরিজমে ৩০ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে।
একটি ভিডিও বার্তায়, পিনাকি সমস্ত ভারতীয় পণ্য, ভারতী টিভি চ্যানেল, সংবাদপত্র বয়কটের আহ্বান জানিয়েছেন। ভারত ভ্রমণ থেকে বিরত থাকারও আহ্বান জানান তিনি। তিনি বাতিঘরসহ আজিজ সুপার মার্কেটের বিভিন্ন বইয়ের দোকান থেকে ভারতীয় বই সরানোর বিষয়ে বলেন।
পিনাকী বললেন, ‘ইন্ডিয়া যাবেন না, চিকিৎসা করাতে হলে ব্যাংকক-সিঙ্গাপুর যান, বেড়াবারও যাবেন না, ম্যালা জায়গা আছে। ভুটান যান, নেপাল যান শ্রীলংকা যান।’
ভিডিওটির শেষের দিকে তিনি বাংলাদেশের বাজারে সহজলভ্য ভারতীয় পণ্যের তালিকা দিয়েছেন। যেমন ভারতীয় ডাবর কোম্পানি ভাটিকা, হিমালয়, এশিয়ান পেইন্ট, ফেভিকল, কোলগেট টুথপেস্ট, ভাটিকা, নটরাজ পেন্সিল, রেমন্ড ক্লথ, আল্ট্রাটেক সিমেন্ট, উজালা পণ্য ইত্যাদি।
এ ছাড়া ভারতীয় পেঁয়াজ, রসুন, ডাল, সয়াবিন তেল, ডালডা বনস্পতি, প্যারাসুট নারকেল তেল, হিরো, এটলাস ইন্ডিয়ান সাইকেল, ভারতীয় শাড়ি, পোশাক, সালোয়ার, কামিজ, সানফার্মার ওষুধ না কেনার কথা জানান তিনি।
সবশেষে ড. পিনাকী বলেন, ‘মাস তিনেকের মধ্যে বাংলাদেশে ভারতের রপ্তানী অর্ধেক করে দিতে পারি তাহলে ওরা আমাদের কাছে আসবে। আওয়ামী লীগকে ছেড়ে পালাবে। ওদের আমরা ভাতে মারব, ওরা আমাদের স্বাধীনতায়, আমাদের অধিকারে, আমাদের মর্যাদায় লাথি দিছে, এখন ওদের পেটে লাথি দিব আমরা, ওদের পেটে লাথি দেওয়া এখন জায়েজ। আমরা এতদিন পড়ে পড়ে মাইর খাইছি, এখন মাইর দেওয়ার পালা, শুরু হোক আজকে থেকেই বয়কট ইন্ডিয়া।’।’
বুধবারের ভিডিও সম্পর্কে ড. পিনাদর সাথে যোগাযোগ করা হলে পিনাকী ভট্টাচার্য বলেন, নরেন্দ্র মোদির সরাসরি রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থনে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদ বাংলাদেশে টিকে আছে। আমরা ভারতীয় পণ্য কিনে ভারতীয় শাসকদের ক্ষমতায়ন করি এবং সেই ক্ষমতা ব্যবহার করে ভারত আমাদের ন্যূনতম নাগরিক অধিকার, মানবাধিকার কেড়ে নিয়ে অবৈধ শাসকদের টিকিয়ে রাখে। এ অবস্থা চলতে পারে না।
তিনি বলেন, ভারত মনে করে বাংলাদেশকে গোলাম হিসেবে রাখলে ভারত নিরাপদ থাকবে। মানুষের মর্যাদায় আঘাত লাগলে সে প্রতিরোধ করবেই। যেই দেশের শীর্ষ নেতা আমাদের উইপোকার সাথে তুলনা করে, তাদের তো আমাদের দেশে কিছু বেচতে আসাই উচিত না। ভারত প্রতিনিয়ত সীমান্তে আমাদের নাগরিকদের হত্যা করে, শুধু কাঁটাতারে ঝুলিয়ে দেয় না। আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে আমাদের নদীগুলোকে তাদের উৎসস্থলে বাঁধ দেয়া হয়েছে, নদীগুলো শুকিয়ে গেছে এবং চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে বাংলাদেশকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় কারাগারে পরিণত করা হয়েছে। আমরা মানুষ, পশু নয়। যারা আমাদের মর্যাদা ও জীবনকে আঘাত করে, আমরা তাদের এভাবে পাল্টা আঘাত করব। প্রয়োজনে ঘাস খাব, কিন্তু দাসত্বের জীবন বেছে নেব না।
উল্লেখ্য, মানবাধিকার লঙ্ঘন, ভোটাধিকার লঙ্ঘন, দমন, নিপীড়নসহ বিভিন্ন কারণে বিতর্কিত আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনা করে নিয়মিত লেখালেখি ও ভিডিও করার কারণে ড. পিনাকী ভট্টাচার্য বিরোধী দলের সমর্থকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়। যদিও কয়েক বছর আগে আওয়ামী লীগ সরকার পিনাকী ভট্টাচার্যসহ বিদেশে অবস্থানরত অন্যদের ‘তথ্য সন্ত্রাসী’ আখ্যা দিয়েছিল।
ভারতীয় পণ্য বয়কটের ডাক বাংলাদেশের বাজারে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা জানান, বৃহস্পতিবার থেকে বিভিন্ন ভারতীয় পণ্য বিক্রিতে ধাক্কা লেগেছে। আর সাধারণ ক্রেতারা বলছেন, বাংলাদেশের ব্যবসা, কৃষি, শিল্পসহ অনেক ক্ষেত্রেই ভারতের প্রভাব দিন দিন বাড়ছে, অনেক দেশীয় প্রতিষ্ঠান বন্ধের পথে। এখন পর্যন্ত কেউ এসব নিয়ে কথা বলেনি। কিন্তু হঠাৎ করেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভারতীয় পণ্য বয়কটের ডাকে সাড়া দিচ্ছেন অনেকে।
ইতিপূরবেও ২০২২ সালে বিজেপির নুপুর শর্মা ও নবীন কুমার জিন্দাল মহানবী (স.) কে নিয়ে কটূক্তি করায় সারা বিশ্বব্যাপী ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দেয়।
মহানবীকে নিয়ে বিজেপির দুই নেতার বিতর্কিত মন্তব্যের কারণে দলটি আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পড়েছে। অন্তত ১৫টি দেশ এ ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া এসেছে। এসব দেশে ভারতের বিরুদ্ধে বিক্ষোভও হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যম এবং পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম বিবিসি-র মতে, মুসলিমরাও সেসব দেশে ভারতীয় পণ্য বয়কটের ঘোষণা দিচ্ছে।
এই ঘটনার পর, টিভি বিতর্কে দলের নেতা ও মুখপাত্রদের অংশগ্রহণ নিয়ে নতুন নিয়ম করেছে বিজেপি। এখন থেকে, শুধুমাত্র অনুমোদিত পার্টির মুখপাত্র এবং প্যানেলিস্টরা টেলিভিশন বিতর্কে অংশ নিতে পারবেন। টিভি বিতর্কে অংশ নেওয়ার জন্য মুখপাত্র ও প্যানেলিস্টদের সিদ্ধান্ত নেবে দলের মিডিয়া সেল।