November 22, 2024
রোহিঙ্গা কারা? রোহিঙ্গা সংকটের ইতিহাস

রোহিঙ্গা কারা? রোহিঙ্গা সংকটের ইতিহাস

রোহিঙ্গা কারা? রোহিঙ্গা সংকটের ইতিহাস

রোহিঙ্গা কারা? রোহিঙ্গা সংকটের ইতিহাস

রোহিঙ্গা কারা?

৭ম শতাব্দীতে, বঙ্গোপসাগরে একটি জাহাজডুবির ঘটনায় বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিরা নিকটবর্তী উপকূলে আশ্রয় নেন। তারা বলেন, “আল্লাহর রহমে আমরা বেঁচে গেছি। ওই ‘রহম’ থেকে রোহিঙ্গা জাতির উৎপত্তি বলে মনে করা হয়। তবে এরও আগে রোসাং ও রোয়াং শব্দগুলো তাদের ক্ষেত্রে  বেশি পরিচিত ছিল।

ইতিহাস:

অষ্টম শতাব্দীতে আরবদের আগমনের সাথে সাথে মুসলমানরা আরাকানে বসতি স্থাপন করে। আরব বংশোদ্ভূত এই জনসংখ্যা মাইয়্যু (বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের কাছে) সীমান্তবর্তী অঞ্চলের পরিবর্তে মধ্য আরাকানের কাছে ম্রোক-উ এবং কাইয়ুকতাও-এর শহরতলিতে বসবাস করতে পছন্দ করে। এই অঞ্চলে বসবাসকারী মুসলিম জনগোষ্ঠী পরবর্তীতে রোহিঙ্গা নামে পরিচিত হয়।

রোহিঙ্গারা পশ্চিম মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের একটি রাষ্ট্রহীন ইন্দো-আর্য জনগোষ্ঠী। অধিকাংশ রোহিঙ্গাই ইসলামের অনুসারী, যদিও কিছুসংখ্যক হিন্দু ধর্মের অনুসারীও রয়েছে। জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের বিশ্বের অন্যতম নিপীড়িত সংখ্যালঘু হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।

ইতিহাস ও ভূগোল থেকে জানা যায় যে রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে বঙ্গোপসাগরের উপকূলে বাঙালি, পারস্য, তুর্কি, মুঘল, আরব ও পাঠানরা দীর্ঘদিন ধরে বসতি স্থাপন করেছে। তাদের ভাষা চট্টগ্রামের স্থানীয় উচ্চারণ দ্বারা প্রভাবিত। এছাড়া উর্দু, হিন্দি, আরবি শব্দও আছে। রাখাইনে মূলত দুটি সম্প্রদায়ের বসবাস, মগ এবং রোহিঙ্গা। মগরা বৌদ্ধ।রোহিঙ্গারা মুসলিম।

যাইহোক, বিগত ৮০০ বছরে, বর্মী, জাপানী এবং মুঘল সৈন্যদের অত্যাচারে তাদের বহুবার স্বদেশ এবং নিজের জন্মভূমি মিয়ানমার থেকে পালাতে হয়েছে। তারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের টেকনাফ ও কক্সবাজার উপকূলে বসতি স্থাপন করেছে। তবে চাষি রোহিঙ্গারা বারবার রাখাইনে ফিরে এসেছে।

রোহিঙ্গা সংকটের ইতিহাস:

ইতিহাস আমাদের বলে যে ১৪৩০ থেকে ১৭৮৪ পর্যন্ত, রোসাং ছিল ২২০০০ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। সেখানে মিয়ানমারের রাজা বোদাওফায়া রাজ্য দখল করার পর বৌদ্ধ শাসন শুরু হয়।

এক সময় এই ভূমি ব্রিটিশদের দখলে চলে আসে। এরপর তারা মিয়ানমারের ১৩৯ টি জাতিগোষ্ঠীর একটি তালিকা তৈরি করে। কিন্তু তাতে রোহিঙ্গাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। বৃটিশ শাসকেরা এরকম অনেক ভুল করেছে। যার পরিণতি রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার।।

৪জানুয়ারী, ১৯৪৮ -এ, মিয়ানমার ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে এবং বহুদলীয় গণতন্ত্রের সূচনা করে। সে সময় সংসদে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল। এই সম্প্রদায়ের কিছু কর্মকর্তা সরকারি দায়িত্বও পালন করেন। কিন্তু ১৯৬২ সালে, জেনারেল নে উইন সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করলে মিয়ানমারের গতিপথ ভিন্ন হতে শুরু করে।

আবারও রোহিঙ্গাদের দুর্ভোগের নতুন অধ্যায় শুরু হয়। সামরিক জান্তা ইচ্ছে করেই রোহিঙ্গাদের বিদেশী হিসেবে চিহ্নিত করে। তারা তাদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে ঐ সময় থেকেই তাদের  ভোটের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। ধর্মীয় নিপীড়নেরও শিকার হয়েছে তারা । ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে প্রতিবন্ধকতা ছাড়াও তাদের মৌলিক অধিকার খর্ব করা হয়েছে। তাদের উপর হত্যা ও ধর্ষণ ছিল নিয়মিত ঘটনার   । এছাড়াও, সম্পত্তি জোরপূর্বক বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল এবং জোরপূর্বক শ্রম আরোপ করা হয়েছিল। তাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা , বিবাহের সুযোগ ছিলইনা ।  । শিশুদের জন্য কোন নিবন্ধন. জাতিগত পরিচয় প্রকাশ করা অনুমোদিত ছিলনা । সংখ্যা যাতে বাড়তে না পারে সেজন্য একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় রোহিঙ্গাদের উপর ।

মিয়ানমারের মূল ভূখণ্ডের অনেকের কাছে রোহিঙ্গারা ‘কালা’ নামে পরিচিত। এই পরিচয়ে সীমাহীন বিদ্বেষ প্রকাশ পায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এই বৈরিতাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। মুসলমানরা ব্রিটিশদের সমর্থন করেছিল এবং অনেক বৌদ্ধ জাপানিদের সমর্থন করেছিল। ১৯৪৮ সালে মায়ানমারের স্বাধীনতার পর, মুসলিমরা সমান অধিকারের জন্য লড়াই করেছিল কিন্তু পরাজিত হয়েছিল, সেইসাথে তাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভাজন আরও গভীর হয়েছিল।

১৯৬২ সালে মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর রোহিঙ্গাদের জন্য পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়। সমস্ত নাগরিককে একটি জাতীয় নিবন্ধন কার্ড পেতে বাধ্য করা হয়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের শুধুমাত্র বিদেশী পরিচয়পত্র দেওয়া হয়েছিল, যাতে  তাদের কর্মসংস্থান ও শিক্ষার সুযোগ একেবারেই  সীমিত করেছিল।

১৯৮২ সালে, মিয়ানমার সরকার একটি নতুন নাগরিকত্ব আইন পাস করে, কার্যকরভাবে রোহিঙ্গাদের রাষ্ট্রহীন করে। আইন অনুযায়ী, রোহিঙ্গারা দেশের ১৩৫ টি জাতিগোষ্ঠীর একটি হিসেবেও  স্বীকৃত নয়। এই আইনে তিন স্তরের নাগরিকত্ব ছিল। সবচেয়ে মৌলিক স্তরের প্রাকৃতিক নাগরিকত্ব প্রমাণে  প্রয়োজন ছিল যে , ব্যক্তির পরিবার ১৯৪৮ সালের আগে মায়ানমারে বাস করত,  পাশাপাশি ঐ   ব্যক্তি জাতীয় ভাষায় সাবলীল ছিল। অনেক রোহিঙ্গার কাছে এ ধরনের নথির অভাব ছিল এবং এমনকি তাদেরকে  শিক্ষা-দীক্ষা  থেকে বঞ্চিত করে রাখার ফলে মিয়ানমারের জাতীয় ভাষাও সাবলীলভাবে বলতে পারেনি ।

ফলস্বরূপ, তাদের পড়াশোনা, কাজ, ভ্রমণ, বিয়ে, তাদের ধর্ম পালন এবং স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার সীমিত করা হয়েছিল। রোহিঙ্গারা ভোট দিতে পারেনি, এবং ওষুধ বা আইন বা অফিসে  কর্ম পাওয়ার মতো  প্রায় সকল পেশার উপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল।

বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রথম অভিবাসন হয়েছিল ১৯৭৮ সালের দিকে। আরেকটি অভিবাসন ঘটে ১৯৯০ এর দশকের শুরুতে। ১৯৯২ সালের আগে, যারা বাংলাদেশে অভিবাসিত হয়েছিল তারা মিয়ানমার সীমান্তের কাছে কক্সবাজারের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে বসতি স্থাপন করেছিল।

রোহিঙ্গারা ১৯৭৮, ১৯৯১-১৯৯২, ২০১২, ২০১৫ ও ২০১৬ এবং অতি সম্প্রতি ২০১৭ সালে সামরিক নির্যাতন ও দমন-পীড়নের সম্মুখীন হয়েছে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরে একটি তদন্ত অনুসারে রোহিঙ্গারা অতি-জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধদের হাতে ঘৃণা ও ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার সম্মুখীন হচ্ছে, রিপোর্ট তারা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, অবৈধ গ্রেপ্তার, মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী দ্বারা নির্যাতন, ধর্ষণ ও নির্যাতনের পাশাপাশি জোরপূর্বক শ্রমের শিকার হয়েছে।

রোহিঙ্গারা কয়েক দশক ধরে মিয়ানমার সরকারের দ্বারা সহিংসতা, বৈষম্য ও নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। ২০১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ব্যাপক সহিংসতা শুরু হওয়ার পর ১০০০০০০-এরও বেশি মানুষ – যাদের অর্ধেক শিশু – বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল৷ চলমান সহিংসতা এবং নিপীড়নের কারণে, কয়েক দশক ধরে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা ভূমি বা নৌকায় করে প্রতিবেশী দেশগুলিতে পালিয়েছে৷

২৫ আগস্ট, ২০১৭-এ, রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলার ১২ নিরাপত্তা কর্মী নিহত হওয়ার ভুয়া অজুহাত দেখিয়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে একটি “ক্লিয়ারেন্স অপারেশন” শুরু করে। এই অভিযানে ৪০০ -৩০০০ রোহিঙ্গা নিহত হয়, অনেক রোহিঙ্গা আহত, নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার হয়। তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়।

আরও জানতে

মালয়েশিয়ায় যেতে গিয়ে সাগরে ডুবে আরও ১৮০ অধিকার বঞ্চিত রোহিঙ্গার মৃত্যু

Leave a Reply

Your email address will not be published.

X