যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ঘোষণায় উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা
দীর্ঘদিনের ডলার সংকট সাম্প্রতিক সময়ে তীব্র হয়েছে। সংকট নিরসনে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি করলে রিজার্ভে চাপ পড়বে এমতাবস্থায় তা মোকাবেলায় গত অর্থবছরের শুরু থেকেই আমদানির ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে সরকার। বিভিন্ন পণ্যের এলসি খোলা নিয়ন্ত্রিত হয়। এটি আমদানিতে তাৎক্ষণিক প্রভাব ফেলেনি, তবে গত বছরের অক্টোবর থেকে প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক হয়ে উঠেছে। এরপর থেকে এলসি খোলার প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে কমছে। ফলে শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতিসহ নিত্যপণ্যের আমদানি কমে যাওয়ায় দেশে পণ্যের দাম দ্রুত বাড়ছে। এ ছাড়া এলসি খুলতে না পারায় দেশের বিভিন্ন বন্দর দিয়ে আমদানি-বাণিজ্যও কমে গেছে। আমদানি কম হওয়ায় রাজস্ব আদায়ে ধস নেমেছে বেনাপোল কাস্টমস হাউসের। অন্যদিকে বিশ্বজুড়ে শ্রম অধিকার নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নীতি ঘোষণায় উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা।
বিশেষ করে পোশাক খাতের ব্যবসায়ীদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। জানা গেছে, গত অর্থবছরের শেষ দিকে আমদানি প্রবৃদ্ধির নেতিবাচক প্রবণতা সবচেয়ে বেশি ছিল। সে সময় ডলারের সংকটও ছিল তীব্র। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও বেশ পরিমাণ এলসির আবেদন খারিজ করে দিয়েছে। দেড় বছর পার হলেও ডলার সংকট নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। চেষ্টা করা হয়েছে কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে বারবার। এতে সংকট আরও গভীর হয়েছে, যার কারণে চলতি অর্থবছরের আমদানি প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক প্রবণতায় রয়েছে।
এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (এসিইউ) মাধ্যমে আমদানি দায় পরিশোধের পর দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ১৯ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। চাহিদা অনুযায়ী এলসি খুলতে না পারায় অনেক উদ্যোক্তা শিল্পের কাঁচামাল, ভোগ্যপণ্য এবং মূলধনী যন্ত্রপাতির মতো প্রয়োজনীয় আমদানি কমিয়ে দিয়েছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৪ মাসে (জুলাই-অক্টোবর) এলসি খোলার হার কমেছে ১১ দশমিক ২২ শতাংশ। এই ৪ মাসে পণ্য আমদানির জন্য মোট ২ হাজার ১৮২ মিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছে। যেখানে গত অর্থবছরের একই সময়ে প্রায় ২ হাজার ৪৬৬ কোটি ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল। এ সময়ে ব্যাংকগুলোর এলসি নিষ্পত্তিও ২৪ শতাংশের বেশি কমেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ৪ মাসে, ব্যাঙ্কগুলি $২৮৯৪ কোটি মূল্যের এলসি নিষ্পত্তি করেছে। সেখান থেকে চলতি অর্থবছরের প্রথম ৪ মাসে তা কমে ২ হাজার ১৯৭ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টানা ১২ মাস আমদানিতে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল উভয়েরই আমদানি কমেছে। গ্যাস সংকটের কারণে উৎপাদন ক্ষমতা ব্যবহার করা যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে অর্থনীতি বড় ধরনের সংকটের দিকে যাচ্ছে।
চলমান ডলারের সংকট এবং এলসি প্যারাডক্সকে এখন উদ্যোক্তারা শিল্প খাতের কোম্পানিগুলোর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন। ভোগ্যপণ্য আমদানিকারকরা জানান, এলসি খুলতে ব্যাংকগুলো নানা শর্ত দিচ্ছে। তাদের মতে, একদিকে যেমন উৎপাদন কমছে, অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির কারণে ভোগ্যপণ্যের বিক্রিও কমছে।
এমজিআই, চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল বলেন, ব্যাংকগুলো এলসি খোলা কমিয়ে দিয়েছে। চাহিদা অনুযায়ী ডলার না পাওয়া বা এলসি খুলতে না পারায় শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমে গেছে। স্বাভাবিকভাবেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে উৎপাদন ব্যবস্থায়।
এদিকে, দেশের পোশাক খাতের সংশ্লিষ্টদের মতে, আইন প্রয়োগ ও ভিসা নীতিতে বিধিনিষেধ আরোপের পর শ্রম অধিকার ইস্যুতে ফোকাস এখন বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং পোশাক খাতে ন্যূনতম মজুরি নিয়ে শ্রমিক বিক্ষোভের পর ঘোষণা করা স্মারকলিপি এখন উদ্যোক্তাদের নতুন করে ভয় দেখাচ্ছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন শ্রমিকদের ক্ষমতায়ন, শ্রম অধিকার এবং শ্রমিকদের জীবনমানের মান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি স্মারক (প্রেসিডেন্সিয়াল মেমোরেন্ডাম) স্বাক্ষর করেছেন।
গত বৃহস্পতিবার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকার, শ্রমিক, শ্রমিক সংগঠন, ট্রেড ইউনিয়ন, সুশীল সমাজ এবং বেসরকারি খাতের সঙ্গে জড়িত আন্তর্জাতিক শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করবে। তিনি বলেন, যারা শ্রমিকদের অধিকারের বিরুদ্ধে যাবে, শ্রমিকদের হুমকি-ধমকি দেবে, প্রয়োজনে তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে।
বিকেএমইএ’র সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন এই নীতিতে অনেকেই চিন্তিত। তবে যুক্তরাষ্ট্র একা বাংলাদেশের জন্য এ পদক্ষেপ নেয়নি। যাইহোক, তবে এই ক্ষেত্রে কোন একগুঁয়েমি কাজ করছে কিনা? এটাও খতিয়ে দেখতে হবে এবং শ্রমিকদের পূর্ণাঙ্গ অধিকার প্রদান করতে হবে । আর রাজনীতিকে সুষ্ঠুভাবে এবং সবার জন্য সমানভাবে পরিচালনা করলেই কেবল এই সমস্যার সমাধান সম্ভব ।
আরও পড়ুন
১১জনকে কামড় দেওয়ার পর অবশেষে হোয়াইট হাউজ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় ‘কমান্ডার’কে