৫০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী বাঘা শাহী মসজিদ
নিচের স্তম্ভ থেকে চোখ চলে যায় চৌচালা আকৃতির গম্বুজের দিকে। সবকিছু সুন্দর পোড়ামাটির নকশা দিয়ে সজ্জিত করা হয়েছে। এই মসজিদটি ৫০ টাকার নোট এবং ১০ টাকার স্মারক ডাকটিকিটে দেখা যেত। রাজশাহীর বাঘা উপজেলার এই শাহী মসজিদটি ৫০০ বছরের প্রাচীন স্থাপত্যের একটি।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, বাগদাদের আব্বাসীয় আমলের খলিফা হারুনুর রশীদের বংশধর হযরত মাওলানা শাহ আব্বাসের পুত্র হযরত মাওলানা শাহ মুয়াজ্জিম উদ্দৌলা অলি তার পরিবার পরিজন ছেড়ে রাজশাহীর বাঘার ঘন জঙ্গলে বসতি স্থাপন করেন। তিনি হযরত শাহদৌলা (রহ.) নামে পরিচিত। বাঘায় এসে তিনি ইসলাম প্রচারের স্বার্থে আধ্যাত্মিক সাধনা শুরু করেন। এ সময় তিনি ঐতিহাসিক এ মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
মসজিদটি পরবর্তীতে ১৫২৩-২৪ সালে হুশেন শাহী রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা আলাউদ্দিন শাহীর পুত্র সুলতান নসরত শাহ দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। সামনে ৫২ বিঘা খাদ খনন করে এর পাশে একটি জায়গা উঁচু করে মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল। মসজিদটি সমতল থেকে ৮ থেকে ১০ ফুট উপরে। এই মসজিদটি রাজশাহী শহর থেকে ৪৮ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত।
মসজিদের প্রাঙ্গণ সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। উত্তর ও দক্ষিণ দিকে দুটি প্রবেশপথ রয়েছে। দুই পাশে দুটি বিশাল গেট। কারুকাজ সর্বত্র। মসজিদের ১০টি গম্বুজের মধ্যে কয়েকটি দৃশ্যমান। প্রধান ফটক থেকে, এই স্থাপত্যশৈলী মসজিদের ভিতরে দর্শনার্থীদের আকর্ষণ করে। ১০ গম্বুজ বিশিষ্ট এই মসজিদের পাঁচটি দরজা রয়েছে। মধ্য দরজার উপরে ফার্সি লিপিতে একটি শিলালিপি রয়েছে। চতুর্ভুজে রয়েছে চারটি চৌচালা আকৃতির গম্বুজ। ভেতরে ছয়টি পিলার। চারটি চমৎকার খোদাই করা খিলান।
এছাড়াও এ মসজিদের দেয়াল ঐতিহ্যবাহী রাজশাহীর আম ও গোলাপ ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। এই মসজিদের দৈর্ঘ্য ৭৫ ফুট, প্রস্থ ৪২ ফুট এবং উচ্চতা ২৪ ফুট ৬ ইঞ্চি। প্রাচীরটি 8 ফুট চওড়া। গম্বুজের ব্যাস ২৪ ফুট। উচ্চতা ১২ ফুট। পোড়ামাটির নকশা সর্বত্র।
তবে কিছু জায়গা নষ্ট হয়ে গেছে। ২০০৭ সালে, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সিরাজগঞ্জের কারিগর মদন পাল্কে দিয়ে আসল নকশাটি প্রতিস্থাপন করে। ১৮৯৭ সালে একটি ভূমিকম্পে বাঘা শাহী মসজিদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শীর্ষ ১০ টি গম্বুজ ভেঙে পড়ে। এরপর থেকে দীর্ঘদিন ধরে মসজিদের অভ্যন্তরীণ অংশ পরিত্যক্ত ছিল। গম্বুজগুলি পরে ১৯৭৬ সালে পুনর্নির্মিত হয়।
মসজিদ সংলগ্ন মাটির নিচ থেকে আবিষ্কৃত হয় মহল পুকুর। ১৯৯৭ সালে, মাজারের পশ্চিম দিকে খনন কাজের সময়, একটি ৩০ ফুট বাই ২০ ফুট বাঁধ প্রাচীরের পুকুর পাওয়া যায়। এটি একটি সুড়ঙ্গ দ্বারা অভ্যন্তরীণ প্রাসাদের সাথে সংযুক্ত ছিল। তিন দিকে আবদ্ধ সিঁড়ি নিচের দিকে নিয়ে যায়। প্রায় ২৫৬ বিঘা জমির উপর এই দিঘী, প্রধান মসজিদ, আউলিয়াদের মাজার, প্রধান দরগা শরীফ ও জাদুঘর। সরকারি ছুটির দিনে বা সাপ্তাহিক ছুটির দিনে এখানে প্রচুর সংখ্যক দর্শনার্থী প্রার্থনা করতে আসেন।
শাহী মসজিদের উত্তর পাশে হযরত শাহদৌলা (রহ.) ও তাঁর পাঁচজন সঙ্গীর মাজার। এই মাজারের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে হযরত শাহ (রহ.)-এর পরিবারের সদস্যদের মাজার রয়েছে। শাহী মসজিদ প্রাঙ্গণের বাইরে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে দুটি দরবেশের মাজার রয়েছে। এ ছাড়া এখানে আসা আরও অনেক সাধুর মাজার এখানে-ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
বাঘা মাজারের জানান, প্রশাসনের কর্মকর্তা ও এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে একটি কমিটি রয়েছে। ওই কমিটি এই মসজিদ ও মাজারের ব্যবস্থাপনা করে। প্রতি শুক্রবার এ মসজিদে নামাজ পড়তে দূর-দূরান্ত থেকে বহু মানুষ আসেন।
চুন ও মর্টার দিয়ে এই বাঘা মসজিদ নির্মাণ করা হয়। মসজিদের ভিতরের ও বাইরের দেয়ালে সুন্দর খিলান ও স্তম্ভ রয়েছে। এছাড়াও এখানে রয়েছে আমগাছ, পদ্মফুল, পাতাসহ অসংখ্য পোড়ামাটির কারুকাজ এবং পারস্য খোদাই শিল্পে ব্যবহৃত হাজার হাজার কারুকাজ। এছাড়া মসজিদ চত্বরের উত্তর পাশে হযরত শাহদৌলা ও তাঁর পাঁচ সঙ্গীর মাজার। বাংলার স্বাধীন সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের পুত্র নাসিরুদ্দিন নসরত শাহ জনকল্যাণের জন্য মসজিদের সামনে একটি কূপ খনন করেন। শাহী মসজিদ সংলগ্ন এই পুকুরটি ৫২ বিঘা জমির উপর। পুকুরটি সারি সারি নারকেল গাছে ঘেরা। প্রতি বছর শীতকালে অসংখ্য দর্শনার্থী পাখির গানে এলাকাটি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। এছাড়া এই মসজিদ সংলগ্ন জহর খাকী পীরের মাজার রয়েছে। মূল মাজারের উত্তর পাশে তার কবর।
এছাড়াও মসজিদের ভিতরে ও বাইরে অনেক পোড়ামাটির ফলক রয়েছে। মসজিদ সংলগ্ন মাটির নিচ থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে মহল পুকুর। মসজিদের অভ্যন্তরে উত্তর-পশ্চিম কোণে একটু উঁচুতে একটি বিশেষ নামাজ কক্ষ রয়েছে। এ মসজিদ সংলগ্ন এলাকায় প্রতি বছর ঈদুল ফিতরের দিন থেকে ৩ দিনব্যাপী ‘বাঘার মেলা’র আয়োজন করা হয়। এই মেলা ৫০০ বছরের ঐতিহ্য ।