হুন্ডি ব্যবসা ও লেনদেন: অবৈধ হলেও কেন মনোযোগী প্রবাসীরা
আমাদের বাংলা অঞ্চলে হুন্ডির প্রচলন সেই প্রাচীনকাল থেকে, যা কখনও থামেনি। সেই হুন্ডি এখন আরও অনেক বেড়েছে। অর্থপাচার বেড়ে যাওয়ায় হুন্ডির চাহিদাও বেশি। হুন্ডির মাধ্যমে যে শুধু প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স আসছে তা নয়, এখন হুন্ডি বাজারে ডলারের দাম বেশি। কিন্তু যারা ধনী ব্যবসায়িক গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত, তারা মূলত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচার করে। আর যারা দুর্নীতি, কর ফাঁকি, চোরাচালান বা অন্য কোনো মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করেছেন, তারা টাকা পাচারের জন্য বেছে নেন হুন্ডিকে।সোজা কথায় কোটি কোটি টাকা বা ডলার যারা অবৈধভাবে বিদেশে জমিয়েছেন। তারা দেশে টাকা পাঠানোর নিরাপদ পন্থা মনে করেন এই অবৈধ হুন্ডিকেই।
হুন্ডি কি?
( হুন্ডি হল একটি নিঃশর্ত লিখিত আদেশ বা একটি নিঃশর্ত দলিল যা একজন ব্যক্তি তার প্রতিনিধির মাধ্যমে অন্য ব্যক্তির কাছে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের টাকা আরেকজন ব্যাক্তির কাছে পৌছে দেয়।)
যদিও এই পদ্ধতিটি মুঘল আমলে পরিচিতি লাভ করে, ব্রিটিশ আমলে এটি জনপ্রিয়তা লাভ করে। তখনকার সময়ে লোকেরা নগদ বহন বা সহজে স্থানান্তরের ঝুঁকি বিবেচনা করে বিভিন্ন কারণে এই পদ্ধতিটি ব্যবহার করত। বর্তমানে প্রায় সারা দুনিয়ায়ই হুন্ডির কোন আইনি মর্যাদা নেই । কারণ এটি অনানুষ্ঠানিক ব্যবস্থার একটি অংশ। এখন প্রবাসী শ্রমিকরা এ পদ্ধতি ব্যবহার করলেও গোপনে ব্যবহার করছেন।
কিভাবে হুন্ডিতে টাকা পাঠায়?
যে ব্যক্তি হুন্ডিতে টাকা পাঠাতে চান তিনি সাধারণত একজন হুন্ডি ব্যবসায়ীর কাছে যান এবং কোন দেশে এবং কাকে কত টাকা পাঠাতে হবে সে সম্পর্কে কিছু তথ্য দিয়ে সেই ব্যবসায়ীকে তার তার টাকা বুঝিয়ে দেন।।
তারপর ব্যবসায়ী ওই দেশের উল্লিখিত স্থানের কাছাকাছি তার যে কোনো এজেন্টের সাথে যোগাযোগ করে এবং তাকে বলে যে, টাকা কোথায় এবং কার কাছে পৌঁছে দিতে হবে। তারপর এজেন্ট টাকাটি যার কাছে পৌঁছে দিতে হবে তার কাছে পৌঁছে দেয়। মূলত এভাবেই হুন্ডিতে টাকা লেনদেন হয়।
কিভাবে হুন্ডি ব্যবসা করে?
ধরা যাক, বিদেশে একজন শ্রমিক তার উপার্জিত অর্থ একজন হুন্ডি ব্যবসায়ীর কাছে নিয়ে যায়। ব্যবসায়ী তার এক এজেন্টকে সে দেশে কোথায় টাকা দিতে হবে তা জানালে এজেন্ট সেই অনুযায়ী টাকা পৌঁছে দেন। এক্ষেত্রে নির্ধারিত ব্যক্তির কাছে তাকে টাকা পৌঁছতে ব্যাংকিং সিস্টেমের চেয়ে অনেক কম সময় ব্যয় হয়।
হুন্ডিতে যা করে তা হল যে প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থার চেয়ে ডলারের রেট কিছুটা বেশি। অর্থাৎ ১ ডলারের রেট ১০০ টাকা হলে ব্যাংকগুলো দিতে পারে ১০৫ টাকা বা ১১০ টাকা। এখানে তারা লাভ হিসাবে খুব কম খরচ রাখে এবং তারা যা রাখে তা মূলত পুরুটাই তাদের নিজেদের লাভ। এভাবেই তারা ব্যবসা করে।
কোন সুবিধার বলে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানো হয়?
- হুন্ডির অনেক জনপ্রিয়তা রয়েছে, যার পেছনে রয়েছে কিছু সুবিধা। সুবিধাগুলো হল:
- টাকা পাঠানোর জন্য গ্রাহককে অফিসিয়াল সময়ে এজেন্টের কাছে যেতে হবে না। প্রকৃতপক্ষে হুন্ডি ব্যবসায়ীদের কোনো সরকারি সময় নেই।
- গ্রাহককে কোনো অতিরিক্ত ফর্ম পূরণ করতে হবে না।
- এই লেনদেনের জন্য তাদের কাছ থেকে কোন অতিরিক্ত ফি নেওয়া হয় না।
- সর্বোপরি, গ্রাহক তুলনামূলকভাবে ভাল বিনিময় হারও পান।
হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানো বৈধ কি?
এতক্ষণে মনে হতে পারে হুন্ডিতো ভালোই । তারা কম লাভ করে এবং গ্রাহককে বেশি দেয়। আবার এখানে গ্রাহক খুশি এবং তারাও খুশি।
কিন্তু জানেন কি এই ব্যবস্থা অবৈধ? এই হুন্ডি প্রথা শুধু বাংলাদেশেই নয় বিশ্বের অনেক দেশেই অবৈধ। যেহেতু এ ব্যবস্থায় সরকারের সরাসরি কোনো লাভ নেই এবং দেশের কোনো লাভ নেই, বরং আরও ক্ষতির সম্ভাবনা বেড়ে যায়, তাই অনেক দেশ এই ব্যবস্থাকে অবৈধ ঘোষণা করেছে।
হুন্ডি প্রতিরোধে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনাঃ
কয়েকদিন আগে হুন্ডি ঠেকাতে সারাদেশে বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখা থেকে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন ব্যবস্থা চালুর সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। বর্তমানে, শুধুমাত্র বিদেশী লেনদেনে নিযুক্ত অথরাইজড ডিলার ব্যাঙ্কের অনুমোদিত শাখাগুলিতে নগদ ডলার কেনা-বেচা করার অনুমতি দেওয়া হয়।
বাংলাদেশে হুন্ডি ব্যবসাঃ
আইএলওর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে যে রেমিটেন্স আসে তার প্রায় ৪৯ শতাংশ আসে এই হুন্ডি পদ্ধতির মাধ্যমে। এটি কোন ছোট ব্যাপার নয় । বোঝাই যাচ্ছে এই মাধ্যমে টাকা পাঠানোর প্রবণতা প্রবাসিসের মধ্যে অনেক বেশি।
কিন্তু আগেই বলেছি, বাংলাদেশে এই হুন্ডি নিষিদ্ধ। বাংলাদেশ সরকার ইদানীং এ ব্যাপারে খুবই কঠোর হয়েছে। আর এই হুন্ডি বন্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক সময়ে সময়ে বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়ে আসছে।
হুন্ডি ঠেকাতে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ওপর কড়াকড়ি নজরদারি আরোপ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স বিতরণে জড়িত থাকার অভিযোগে কয়েকদিন আগে অনেক মোবাইল ব্যাংকিং ডেভেলপমেন্ট এজেন্টের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়।
হুন্ডি আইন ও শাস্তিঃ
যেহেতু মানি লন্ডারিং এর অধীনে মানি লন্ডারিং এর বিচার করা হয় এবং হুন্ডির কার্যক্রম মানি লন্ডারিং আইনের অধীনে আসে, তাই এই আইনের অধীনে বিচার করা হয়।
উল্লিখিত আইনে, অর্থ পাচারের অপরাধ শাস্তিযোগ্য:
ব্যক্তির ক্ষেত্রে:
অন্যূন ৪ বছর এবং অনধিক ১২ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির দ্বিগুন মূল্যের সমপরিমাণ বা ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত, যাহা অধিক, অর্থদণ্ড।
প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে:
অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির মূল্যের অন্যূন দ্বিগুণ অথবা ২০ লক্ষ টাকা, যাহা অধিক হয়, অর্থদন্ড এবং উক্ত প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন বাতিল করা।
সবশেষে বলা যায়, সীমান্ত এলাকার ব্যাংকগুলোতে কেন টাকার প্রবাহ বাড়ছে, এই টাকার উৎস কী ইত্যাদি বিষয়গুলো যথাযথভাবে পর্যবেক্ষণ করে সহজেই হুন্ডি ব্যবসার রহস্য উদঘাটন করা সম্ভব।