সুদের শাস্তি কী? সুদের সামাজিক ক্ষতি
জাহিলী যুগে (মুহাম্মদ স. আগমনের ঠিক পূর্ববর্তী যুগ) সুদকে একটি সামাজিক ইস্যুতে পরিণত করা হয়েছিল।সুদ আর স্বার্থ ছাড়া জীবনকে তারা অচলই মনে করত। বর্তমান যুগেও সুদের প্রবণতা অনেক বেড়ে গেছে । সুদকে বর্তমানে আশীর্বাদ মনে করা হয়। কিন্তু ইসলামে সুদ হারাম। সুদের যাবতীয় কাজকর্মও নিষিদ্ধ। মহান আল্লাহ সুদের বিপরীতে বিক্রির অনুমতি দিয়েছেন। বলা হয়, ‘আল্লাহ ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন। (সূরা বাকারা : ২৭৫)
সুদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই অভিশপ্ত। সুদ দেওয়া-নেওয়ার সঙ্গে জড়িত সবাইকে নবীজি (স.) অভিশাপ দিয়েছেন। বর্ণিত হয়েছে, ‘যে সুদ খায়, যে সুদ খাওয়ায়, যে সাক্ষী থাকে এবং যে ব্যক্তি সুদের হিসাব-নিকাশ বা সুদের চুক্তিপত্র ইত্যাদি লিখে দেয় সবার প্রতি রাসুলুল্লাহ (স.) লানত করেছেন।’ (তিরমিজি)
সুদগ্রহীতা নিজেই আল্লাহ ও রাসূলের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত। তাই সুদকে ত্যাগের নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ, আল্লাহকে ভয় কর এবং যদি তোমরা মুমিন হও, তবে সুদের যা অবশিষ্ট আছে তা পরিত্যাগ কর। কিন্তু যদি তা না কর, তবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিও। আপনি যদি ক্ষমা চান, তাহলে আপনার জন্য আপনার মূলধন আছে। অন্যায় করো না এবং তোমাদের প্রতি জুলুম করা হবে না।’ (সূরা বাকারা : ২৭৮)
কোরআন-হাদিসে সুদের ক্ষেত্রে যত কঠোর ভাষা প্রয়োগ করা হয়েছে অন্য কোনো গুনাহর ব্যাপারে এমনটি করা হয়নি। বিবাহিত নারী-পুরুষের ব্যভিচার বেশি নিন্দনীয়। এর চেয়েও বেশি নিন্দনীয় প্রতিবেশীর সঙ্গে ব্যভিচার করা। আর স্বীয় মায়ের সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া কী পরিমাণ জঘন্য হতে পারে? সুদখোর সম্পর্কে বলা হয়েছে, সে তার মায়ের সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার সমান অপরাধে জড়িত। বর্ণিত আছে, ‘সুদ ৭০ প্রকার পাপের সমষ্টি। তার মাঝে সবচেয়ে নিম্নতম হলো—আপন মায়ের সঙ্গে ব্যভিচার করার সমতুল্য।’ (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক)
“সুদ থেকে অর্জিত এক দিরহাম বা প্রায় ৩০০টাকা ইসলামের দৃষ্টিতে ৩৬ বার ব্যভিচার করার চেয়েও গুরুতর অপরাধ।” (মুসনাদে আহমাদ )
সুদকে সাতটি মারাত্মক পাপের একটি বলা হয়। রাসুল (সাঃ) বলেছেন, সাতটি ধ্বংসাত্মক কাজ পরিহার কর। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল, সেই সাতটি ধ্বংসাত্মক কাজ কী? তিনি বললেন, আল্লাহর সাথে শরীক করা; মানুষকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা, যা আল্লাহ হারাম করেছেন; সুদ খাওয়া; এতিমদের সম্পদ আত্মসাৎ; জিহাদের ময়দান থেকে পলায়ন করা; পবিত্র মুমিন নারীদের অপবাদ।’ (বুখারি : ২৭৬৬)
সুদের শাস্তি
- সুদের শাস্তি সম্পর্কে মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করেছেন,‘যারা সুদ খায়, তারা কেয়ামতের দিন দন্ডায়মান হবে, যেভাবে দন্ডায়মান হয় ওই ব্যক্তি; যাকে শয়তান আসর করে মোহাবিষ্ট করে দেয়। তাদের এ অবস্থার কারণ এই যে, তারা বলেছে, ক্রয়-বিক্রয়ও তো সুদ নেওয়ারই মতো! অথচ আল্লাহ তাআলা ক্রয়-বিক্রয় বৈধ করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন। এরপর যার কাছে তার পালনকর্তার পক্ষ থেকে উপদেশ এসেছে এবং সে বিরত হয়েছে, আগে যা হয়ে গেছে, তা তার। তার ব্যাপার আল্লাহর উপর নির্ভরশীল। আর যারা পুনরায় সুদ নেয়, তারাই জাহান্নামে যাবে। তারা সেখানে চিরকাল অবস্থান করবে।’ (সুরা বাকারা: ২৭৫)
- সুদগ্রহীতা কবরের জীবনে মৃত্যুর সময় থেকে কেয়ামত পর্যন্ত যন্ত্রণা ভোগ করবে। তার শাস্তি হবে- তাকে এমন একটি নদীতে সাঁতার কাটতে হবে যার পানি রক্তের মতো লাল হবে এবং তাতে তার ওপর পাথর নিক্ষেপ করা হতে থাকবে। (বুখারি:)
- রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আমি মেরাজের রাতে কিছু লোককে দেখেছি, যাদের পেটগুলো বিশাল ঘরের মতো সামনের দিকে বের হয়ে আছে। তা ছিল অসংখ্য সাপে পরিপূর্ণ। যেগুলো পেটের বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে জিবরাঈল, এরা কারা? তিনি জবাবে বলেন, এরা সুদখোরের দল। (মুসনাদে আহমদ)
সুদের সামাজিক ক্ষতি
- সুদ কল্যাণের দরজা বন্ধ করে দেয়। ফলে তারা একে অপরকে শর্তহীনভাবে ঋণ দেয় না। সুদের জন্য দরিদ্রদের কোন অবকাশ দেওয়া হয় না। এবং তাদের কোন বিপদের দিকেও মনোযোগ দেওয়া হয় না।
- সুদ সম্পদ কমায়। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ সুদ কম করেন এবং দান-খয়রাত বৃদ্ধি করেন, (সূরা বাকারা : ২৭৬)।
- ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, সুদ বেশি হলেও তার পরিণতি হ্রাসের দিকে। (মুসনাদে আহমাদ )
- দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায় । কারণ ঋণগ্রহীতাও পণ্যের সুদের হার যোগ করে।
- পৃথিবীর সমস্ত সম্পদ গুটিকয়েক লোকের হাতে কেন্দ্রীভূত।
- সুদ মানুষকে অপচয়ের দিকে নিয়ে যায়। যারা সুদ গ্রহণ করে, সেই টাকা অপচয় করতে তাদের কোনো দ্বিধা নেই।
- যেহেতু সুদ একটি গুরুতর পাপ, তাই এই পাপে লিপ্ত হয়ে তাকওয়া বা খোদাভীতি হারিয়ে ফেলে।
- সুদ মানুষের আত্মার উপর শিরকের মত প্রভাব ফেলে। সুদের গুনাহের ৭০টিরও বেশি দরজা রয়েছে। শিরকের পাপ সুদের মতো।
- হৃদয়ে সম্পদের লালসা সৃষ্টি করে। সুদগ্রহীতা কম সম্পদে সন্তুষ্ট হয় না। সে আল্লাহর আইনকে সম্মান করে না।
- সুদের প্রভাবে মানুষের অন্তরে কৃপণতা সৃষ্টি হয়।
- সুদ অহংকারের কারণ। ফলে তার সামনে সম্পদ ছাড়া আর কিছুই নেই।
- সুদের কারণে দরিদ্র ব্যক্তি অসহায় আরও বোধ করে এবং তার কোন সাহায্যকারী থাকেনা । ফলে তার অন্তরে বিদ্বেষের বীজ বপন করা হয়।
- সুদ মানুষের পাপের প্রবণতা বাড়ায়। একবার পাপ করার ভয় থাকে না অন্তরে।
- সুদে ধনীদের সম্পদ কষ্টবিহীন উপার্জিত হয়। । ফলে সে অলস হয়ে পড়ে।
- হারাম রিজিকের কারণে আল্লাহ সুদগ্রহীতার দুআ কবুল করেন না।
সুদ খেলে অন্তরে কালো দাগ পড়ে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘না, বরং তাদের উপার্জনের কারণে তাদের অন্তরে মরিচা লেগেছে’ (সূরা মুতাফফিফিন: ১৪)। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “নিশ্চয়ই শরীরে এক টুকরো গোশত আছে, তা সুস্থ থাকলে পুরো শরীর সুস্থ থাকে।” আর যখন তা ধ্বংস হয়ে যায় তখন পুরো শরীরই ধ্বংস হয়ে যায়। আর সেটা হল হৃদয়।’ (বুখারি )
সুদ পবিত্র বস্তু থেকে বঞ্চিত হওয়ার একটি কারণ। সর্বশক্তিমান আল্লাহ বলেন, ইহুদিদের অন্যায়ের কারণে আমি তাদের ওপর পবিত্র বস্তু হারাম করেছি, যা তাদের জন্য হালাল ছিল। আর তারা আল্লাহর রাস্তা থেকে অধিক হারে নিষেধ করার কারণে এবং তারা সুদ নেওয়ার কারণে। অথচ তাদের তা থেকে নিষেধ করা হয়েছে। আর তারা মানুষের সম্পদ অবৈধভাবে ভক্ষণ করার কারণে (পবিত্র বস্তু হারাম করেছি)। কাফিরদের জন্য আছে বেদনাদায়ক শাস্তি। (সুরা নিসা, আয়াত : ১৬০-১৬১)
সুদের সাথে সম্পৃক্ত সবাই অভিশপ্ত। তাই সে আল্লাহর রহমত থেকে দূরে থাকে। আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) সুদগ্রহীতা, সুদদাতা, সুদের সাক্ষী, সুদের লেখক, বিয়ে হালালকারী (হিল্লা বিয়ে সম্পাদনকারী) ও যার জন্য হালাল করা হয়েছে, দাগ দানকারী, দাগগ্রহীতা, যারা সদকা দেয় না, তাদের সবার প্রতি অভিশাপ দিয়েছেন। আর তিনি বড় আওয়াজে ক্রন্দন করতে নিষেধ করেন। (মুসনাদে আহমদ)
এ ছাড়া সুদের অনেক ক্ষতি রয়েছে যা গণনা করা যায় না। কিন্তু আমাদের জন্য এতটুকু মনে রাখাই যথেষ্ট যে, যা আল্লাহ তায়ালা নিষেধ করেন তার মধ্যে রয়েছে শুধু মন্দ ও মন্দ। যার লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি। পরিশেষে, এবং সমস্ত মুসলমানদের জন্য ইহকাল ও পরকালের শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করি।
আল্লাহ তায়ালা মুসলিম উম্মাহকে সুদের ভয়াবহ ক্ষতি ও পরিণতি সম্পর্কে সচেতন হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমীন