বিবাহ বিচ্ছেদে বাংলাদেশের যে জেলা সবচেয়ে বেশি এগিয়ে
বিবাহ বিচ্ছেদে এগিয়ে নারীরা। এই জেলায় বিগত যে কোন সময়ের তুলনায় গত বছর ও এ বছর তালাকের হার উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। সিটি করপোরেশন বলছে, বিবাহবিচ্ছেদের আবেদনে নারীরাই এগিয়ে রয়েছে। আর বিবাহবিচ্ছেদ বৃদ্ধির কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, সন্দেহ, যৌতুক দাবি, সঙ্গীর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, স্বামী-স্ত্রীর জীবনে অসঙ্গতি, সন্তান না হওয়া, আর্থিক অসচ্ছলতা, স্বামী-স্ত্রী বা দীর্ঘ সময়ের জন্য বিদেশে অবস্থান, পরকীয়া. আর মাদকাসক্তিসহ নানা কারণে বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা বাড়ছে। সে স্বপ্নের জেলার নাম সিলেট জেলা।
চলতি বছরের প্রথম আট মাসে সিলেটে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা। সিলেট নগরীতে ২৫৩টি তালাকের আবেদন জমা পড়েছে। যার বেশির ভাগই করেছেন স্ত্রী।
২৫৩ টি বিবাহবিচ্ছেদের আবেদনের মধ্যে ১৩৯টি নারীরা দাখিল করেছেন। শুধু সিলেট জেলাতেই গত আট মাসে ২ হাজার ১৩৯ টি তালাকের ঘটনা ঘটেছে। সে ক্ষেত্রে নারীরা এগিয়ে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের মতো অবৈধ সম্পর্কই এতগুলো বিবাহবিচ্ছেদের পেছনে রয়েছে। ডিজিটাল যুগে তরুণ-তরুণীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে নিজের সিদ্ধান্তে বিয়ে করছেন। পরিবার শেষ পর্যন্ত রাজি হয় কিন্তু কোনো কিছুর দায়িত্ব নেয় না। ফলে পারিবারিক কলহ বাড়ছে। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও শৃঙ্খলা মেনে চলার প্রবণতা কমে যাচ্ছে। বিচ্ছেদ বেশি হয়।
সংশ্লিষ্টরা আরও বলছেন, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক ছাড়াও শারীরিক অক্ষমতা, পারিবারিক কলহ ও যৌতুককেও বিবাহ বিচ্ছেদের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। এ থেকে পারিবারিক সচেতনতাকে গুরুত্ব দেওয়ার কথাও বলা হয়।
বিবাহবিচ্ছেদ শিশুদের জীবনে অনিশ্চয়তা নিয়ে আসে। মানসিক সমস্যাও আছে। তাদের ভবিষ্যৎ প্রভাবিত হয়।
বিবাহ সম্পর্কিত কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্টরা বলছেন, সিলেটে বিবাহ বিচ্ছেদের এক নম্বর কারণ আমি মনে করি পরকীয়া। এ অঞ্চলের অধিকাংশ পুরুষই প্রবাসী। একাকীত্ব কাটাতে নারীরা পরকীয়ার মতো ভয়ানক পাপে লিপ্ত হয়। আরেকটি কারণ পারিবারিক চাপ। দাম্পত্য জীবনে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অভাবও অন্যতম কারণ। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, যৌতুক ও অর্থনৈতিক কারণেও বিচ্ছেদ ঘটে।
ছেলেটির পরিবার মেয়েটিকে সেভাবে দেখে না; তাই প্রতিটি ছেলের পরিবারকে দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। সম্পর্ক হয় দ্বিমুখী, অ – স্বাস্থ্যকর এবং নিপীড়ন মূলক । তাই সম্পর্কের গুরুত্ব উভয়ের পরিবারই জানা দরকার। প্রতিটি সম্পর্কের একটি সীমানা থাকে, কিন্তু বেশিরভাগ পুরুষ এবং মহিলা তা জানেন না। এসব বিষয়ে সচেতন হওয়া জরুরি।
সিলেট জেলা বিবাহ নিবন্ধকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত আট মাসে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য মোট ২৫৩টি আবেদন জমা পড়েছে। গত জানুয়ারিতে স্বামীর দ্বারা ৩২ এবং স্ত্রী দ্বারা ৫০;ফেব্রুয়ারিতে পুরুষ ৭ ও নারী ১৩; মার্চে পুরুষ ১৬ ও নারী ১৪; এপ্রিলে পুরুষ ১৫ ও নারী ১৪; মে মাসে পুরুষ ৯ ও নারী ১৪; জুনে পুরুষ ১৮ ও নারী ১৬; জুলাইয়ে পুরুষ ৮ ও নারী ১০ এবং আগস্টে পুরুষ আবেদন করেছেন ৯টি ও নারী আবেদন করেছেন আটটি। সিলেট সিটি করপোরেশন জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৫২টি তালাক কার্যকর করেছে। 1 জুলাই, ২০২৩ থেকে ৩০ জুন, ২০২৪ পর্যন্ত মোট বিবাহ নিবন্ধনের সংখ্যা ২০৯২৩ টি । বিপরীতে বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যা ২ হাজার ১৩৯ জন।
জেলা কাজী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক বলেন, মহানগরে অনেক তালাকের আবেদন রয়েছে। তবে শহর ও জেলায় মেয়েদের আবেদনের সংখ্যা বেশি। বিবাহ বিচ্ছেদের প্রধান কারণ হল শারীরিক অক্ষমতা, পারিবারিক কলহ, যৌতুক এবং পরকীয়া। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে পরিবার থেকে সচেতনতা বাড়াতে হবে।
নারীরা আগের চেয়ে অনেক বেশি সক্রিয় এবং তাদের সক্ষমতা বাড়ছে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুরুষেরা নারীর কাজের ন্যূনতম স্বীকৃতিও দেন না। প্রেমের বিয়েতে স্বামী-স্ত্রীর সমবয়সী হলে ঝামেলা বেশি হয়। কে কার অধীনে থাকবে, কেন থাকবে এই মত অহংকার-কেন্দ্রিক তুচ্ছ বিষয় নিয়েও বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটছে। প্রেমের বিয়ের ক্ষেত্রে পুরো সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব স্বামী-স্ত্রী উভয়ের ওপরই বর্তায়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমান যুগে শিশুরা একে অপরকে বিশ্বাস করে না। সবাই তাদের স্বাধীনতা চায়। উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্যরা মনে করেন তাদের অনেক টাকা আছে এবং বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা নেই। আর নিম্নবিত্ত পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রত্যাশা-প্রাপ্তির ব্যবধান বেশি। ফলে ঝগড়ার সৃষ্টি হয়। আবার মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরা প্রকাশ্যে লজ্জায় ঘর ভাঙতে রাজি নন।